ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চেয়েছেন

তিন বীরাঙ্গনার চোখে অন্ধকার

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

তিন বীরাঙ্গনার চোখে অন্ধকার

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ২১ বছরের যুবতী। দুই ভাই দেশের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় পাক হানাদার ও তাদের দোসররা তাকে তুলে নিয়ে যায় পাকবাহিনীর ক্যাম্পে। তারপর একটানা পাঁচ দিন ওই ক্যাম্পে আটকে রেখে চলে নির্যাতন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়নের চাংগুরিয়া গ্রামের মৃত ওয়াহেদ সরদারের মেয়ে কহিনুর বেগম বীরঙ্গানা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেও এখন তিনি আশ্রয়হীন। বর্তমানে তিনি তার জামাতার বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটির অনুরাগ গ্রামে বসবাস করছেন। চলতি বছরের ১৪ মার্চ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ৬৭ রীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই তালিকার ৫১ নম্বরে আছে কহিনুর বেগমের নাম। উজিরপুরের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা বীরাঙ্গনা কহিনুর বেগম জানান, তার আপন দুই ভাই হেমায়েত সরদার ও আনোয়ার সরদার দেশমাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় পাকবাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গুঠিয়া ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন করে। এ কারণে দেশ স্বাধীনের পর তাকে কেউ বিয়ে করতে রাজি হয়নি। দীর্ঘ সময় তাকে এই লজ্জার কারণে একাকী জীবন কাটাতে হয়েছে। জুটেছে অপবাদ ও লাঞ্ছনা। একপর্যায়ে তিন সন্তানের জনক আব্দুল হামিদ খানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। হামিদ খান দুই সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় দ্বিতীয় স্ত্রী কহিনুরের জীবন চলে অর্ধাহারে ও অনাহারে। ওই ঘরে চার মেয়ে মনি, মুক্তা, দিতি, শ্রাবন্তি ও এক ছেলে নাঈম খান জন্ম নেয়। ছয় বছর আগে স্বামী হামিদ খান মারা যান। চার মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন অসচ্ছল পরিবারে। একমাত্র ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসে স্বল্প বেতনে চাকরি করে। কহিনুর বর্তমান সরকারের আমলে বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়ে মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। ওই টাকা দিয়ে মোটামুটি চলছে তার খাওয়া-পরা ও চিকিৎসা। আশ্রয়হীন কহিনুর বেগম তার মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। অপরদিকে বীরাঙ্গনা বিভা রানী তার প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে আজও সেলাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সংসারের চাকা সচল রাখতে মাঝেমধ্যে তাকে ধাত্রীর কাজ করতে হয়। জীবনযুদ্ধে প্রতিবন্ধী সন্তান সাগরকে নিয়ে বিভা রানীর আরেক সংগ্রাম। বীরাঙ্গনাকে নিয়ে ঘর করতে রাজি না হওয়ায় স্বামীও তাকে ত্যাগ করেছে। আর জীবনযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায় বৃদ্ধা বিভা রানী সন্তানকে নিয়ে সাগরে ভাসছেন। তিনি বলেন, সাগরকে নিয়ে আজ আমি সাগরে ভাসছি। গৌরনদী উপজেলার টরকী বন্দরসংলগ্ন বাবা উমেশ চন্দ্রের আড়াই কাঠা জমিতে টিনের ঘর। এ টিনের ঘরেই একমাত্র ভাই উপেন্দ্র নাথ ম-লকে নিয়ে বিভারানী সেলাই মেশিন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই বিভা রানী আনমনা হয়ে যান। বলেন, আমার বাবা টরকীরচরে বহুদিন বসবাস করেছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। এখানে আমরা চার বোন ও এক ভাই ছিলাম। ১৯৭১ সালে আমি টরকী হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলাম। জ্যৈষ্ঠ মাসে এখানে পাকিস্তানী মিলিটারিদের নিয়ে আসে রাজাকাররা। চারদিকে আগুন দিতে শুরু করে। আমার বাবা তখন পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থান করেন। এমন সময় সবাই বাবাকে স্থান ত্যাগ করতে বললে বাবা আমাদের নিয়ে কালকিনির রমজানপুরের দিকে ছুটলেন। তখন আমরা দ্বিগি¦দিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিলাম। আমিসহ অনেকে (সঙ্গত কারণেই নাম উল্রেখ করা হলো না) আখক্ষেতের মাঠে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যাই। সেদিন ওদের হাত থেকে আমরা কেউ রেহাই পাইনি। আমি নির্যাতনের কারণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। পরবর্তীতে আমাদের বাবা খুঁজে ঘরে নিয়ে আসেন। টরকী বন্দরে এসে আমরা দেখি বন্দরটি হানাদাররা পুড়িয়ে দিয়েছে। বাবা শ্রাবণ মাসে একই গ্রামের অনুকুল মজুমদারের সঙ্গে আমার বিয়ে দেন। পরবর্তীতে আমরা দুটি পরিবারের ১০ জন টরকী থেকে নৌকাযোগে আট দিন পর ভারতে গিয়ে পৌঁছি। দেশ স্বাধীনের পর সবাই আবার দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে আমার স্বামী আমার ওপর রাজাকারদের নির্যাতনের কাহিনী জানতে পেরে হঠাৎ কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে যায়। পরবর্তীতে ছেলে সাগর জন্মাবার চার মাস পর ফের ফিরে এসে আমাকে ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে কোন রকম বেঁচে আছি। তিনি আরও বলেন, আমি আগে তাঁতে লুঙ্গি বুনতাম। ছোটবেলা থেকেই সেলাইয়ের কাজ করতাম। তাই এখন অর্ডারে ব্লাউজ, ছায়া সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করছি। মাঝখানে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবেও আমি ১০ বছর কাজ করেছি, যে কারণে আমাকে আশপাশে ধাত্রীর কাজও করতে হয়। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানোর কারণে আমার সংসারজীবন ভেঙ্গে গেছে। আজও সরকারীভাবে আমি কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। এমনকি আমাদের কোন তালিকাও করা হয়নি। অথচ আমার জীবন কাহিনী স্থানীয় সকল মুক্তিযোদ্ধা জানে। নিজস্ব সংবাদদাতা ঠাকুরগাঁও থেকে জানান, পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে পাকিস্তানী সেনা ও রাজাকাররা ইচ্ছামতো নির্যাতন করত। সবার কথা চিন্তা করে সব মুখ বুজে সহ্য করেছি। আমাকে মেরে ফেলার জন্য আমি পাকিস্তানী সেনাদের বারবার আকুতি করেছি কিন্তু তারা তা করেনি। কথাগুলো বললেন ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার বলিদ্বারা গ্রামের টেপরি রানী। মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে ১৬ বছর বয়সে তার বিয়ে হয় শিয়ালডাঙ্গী গ্রামের মাটাং রায়ের সঙ্গে। একাত্তরের মে মাসে রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানী সেনারা প্রথমে তাকে ধরে নিয়ে যায় শিয়ালডাঙ্গী ক্যাম্পে। সেখানে তারা তিন দিন আটকে রেখে নির্যাতনের পর ছেড়ে দেয়। কিন্তু তখনও তার জীবনের দুর্দশা শেষ হয়নি। মাসখানেক পর ফের তিনি আটক হন এবং মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে শিয়ালডাঙ্গীসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে তাকে নির্যাতন করে পাকিস্তানী সেনারা। সেসব নির্যাতনের কথা মনে পড়লে আজও শিউরে উঠি। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর বলিদ্বারা গ্রামে আবার বসবাস শুরু করি। কিন্তু নির্যাতিত হওয়ায় আমাদের পরিবারকে প্রায় দুই বছর একঘরে করে রাখে স্থানীয় লোকজন। আমাদের সঙ্গে কেউ লেনদেন করত না, কথা পর্যন্ত বলত না। এরমধ্যে ১৯৭৩ সালে আমার স্বামী মাটাং রায় অসুখে মারা যান। তারপর থেকে আমার দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছি। ছেলে সুধীর ভ্যানচালক। টেপরি রানীর আকুতি, সুধীরের বড় মেয়ে (তার নাতনি) জনতা রায়কে যেন সরকার সরকারী চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। জনতা রায় ২০১৪ সালে রাণীশংকৈল ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। টেপরি রানীর মতো রাণীশংকৈল এলাকায় আরও অনেক বীর নারী রয়েছেন। তারা হলেনÑ কেউটান গ্রামের ঝরনা রানী মুল, তীর্থবালা পাল, রাউতনগর গ্রামের আসমা বেগম, হাফেজা বেগম, মুনি কিস্কু, সীতা হেমব্রোম, সুবি বাসুগি, জবেদা বেওয়া, হনুফা বেওয়া, সাজেদা বেগম, রওশন বেওয়া, শিদলী গ্রামের নিহার রানী দৈবা, ফাড়াবাড়ি গ্রামের হাসিনা বেগম, হালিমা বেগম, ভারা গ্রামের চানমনি, লেহেম্বা গ্রামের ঝড়ু বালা, পকম্বা গ্রামের নুরজাহান বেগম, পদমপুর গ্রামের হাসিনা বেগম; গোগর গ্রামের মালেকা বেগম, শামাডাঙ্গী গ্রামের জমেলা বেওয়া, নিয়ানপুর গ্রামের তিন বোন মালেকা বেগম, আমেনা বেগম ও মোকলেছা বেগম।
×