ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রতনপুরের যুদ্ধে কবরে ঢুকে ওখান থেকেই গুলি চালিয়েছি ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আনোয়ার হোসেন

হরগঙ্গা কলেজে পাক আর্মি ক্যাম্পে হামলার পরই ওরা মুন্সীগঞ্জ ছাড়ে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

হরগঙ্গা কলেজে পাক আর্মি ক্যাম্পে হামলার পরই ওরা মুন্সীগঞ্জ ছাড়ে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ ‘ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে মুক্তারপুরের কাছে নয়াগাঁও চিতাশালা থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে পাকবাহিনীর গানবোট লক্ষ্য করে মর্টার নিক্ষেপ করে সফল হামলা চালাই। পরক্ষণেই পাশে থাকা পাক হানাদারদের আরেকটি গানবোট থেকে আমাদের লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি নিক্ষেপ করে। ভাগ্য ভাল এতে আমরা হতাহত হইনি। আমি হামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সঙ্গের সহযোদ্ধা আর্মি বলছিল স্যার সরে যান পাল্টা হামলা হতে পারে। আমরা সরে যাওয়ার মুহূর্তে আমাদের কাছেই গুলি এসে পড়ে।’- মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের কাছে সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুন্সীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি এসপি আনোয়ার নামেই বেশি পরিচিত। তিনি মুন্সীগঞ্জ শহরের ইদ্রাকপুর গ্রামের বাসিন্দা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে কাজী আনোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএসসির ছাত্র। থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক হল) সিঁড়ি সংলগ্ন ১৩ নম্বর রুমে। ছাত্রদের সতর্ক করে দিতে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু খবর পাঠান, রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেড হতে পারে। খবর পাওয়া মাত্রই রাতে হল থেকে হেঁটে মুন্সীগঞ্জে চলে আসেন তিনি। পরদিন সকালে খবর পান পাকবাহিনী ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে আসছে। বন্ধু পঞ্চসারের নয়াগাঁওয়ের ফজলুল হকসহ অনেকে প্রতিরোধ করতে পুলিশ লাইনের ট্রেজারি থেকে অস্ত্র নিয়ে দু’ লঞ্চ ভর্তি করে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া যান। তারা দেখতে পান, পাক হানদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যানসহ ভারি অস্ত্র নিয়ে আসছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ফিরে আসেন মুন্সীগঞ্জে। পর দিন ২৭ মার্চ ফজলুল হকসহ ভারতে রওনা হন। কুষ্টিয়া হয়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা পৌঁছান। সেখানে তোফায়েল আহমেদ ও শাহ মোয়াজ্জেমসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা হয় তার। এই নেতারা তাকে কুচবিহারে পাঠান। পরে তিনি কুচবিহারের চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে যান। সেখানে ট্রেনিং নেন প্রায় দু’মাস। ট্রেনিংয়ে ভাল করায় এক মাস পরেই কাজী আনোয়ারকে উইং কমান্ডার করে দেন প্রশিক্ষক আর্মিরা। তার ভাষায়,? ট্রেনিংয়ের সময় আরও ৩০ জন বাংলাদেশ থেকে কুচবিহারে ট্রেনিংয়ে যায়। আমি তাদের ট্রেনিং করাতাম। ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের ক্যান্টনমেন্টের এক বিহারী সুবেদার দিয়ে পাঠাল পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য। সেই বিহারী সুবেদার আমাদের ট্রেনিংয়ের নামে সারাদিন নানা নির্যাতন চালায়। রাতে ক্যান্টনমেন্টে এসে আমরা সুবেদারের বিরুদ্ধে সেখানকার মেজর গোর্খার কাছে অভিযোগ দেয়ার পর তাকে সঙ্গে সঙ্গেই সাসপেন্ড করা হয়। ট্রেনিং শেষ করে আমরা চব্বিশ পরগনায় আসি। আমার সঙ্গে ফজলু, সিরাজদিখানের আলীম ও টঙ্গীবাড়ির লতিফসহ আনেকেই ছিল। সেখানে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল আমাদের কয়েকদিন অপারেশনে পাঠানোর পর মেলাঘরে পাঠিয়ে দেন। মেলাঘরে আমাদের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও মেজর হায়দারের সঙ্গে দেখা হয়। তারাও আমাদের অপারেশনাল ট্রেনিং করিয়ে আগরতলা দিয়ে মুন্সীগঞ্জে পাঠিয়ে দেন। আসার সময় আমাদের সঙ্গে ছিল এলএমজি, মর্টার, গ্রেনেড, মেশিনগানসহ ভারি অস্ত্রশস্ত্র। আগরতলা থেকে হেঁটে ও নৌকায় গজারিয়া হয়ে মুন্সীগঞ্জে আসতে আমাদের সময় লেগেছে ৪/৫দিন। আসার পথে পাক হানাদার বাহিনীর কারণে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তারা রাস্তায় ও ব্রিজে পাহারা দিত। রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের খবর নিয়ে পাক বাহিনীকে জানাত। আসার পথে স্থানীয় জনগণ আমাদের সহযোগিতা করে। যখন পাক সেনারা রেস্টে থাকত বা অন্য কোথাও যেত তখন আমরা নদী পার হতাম বা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতাম। মুন্সীগঞ্জে আসার পর প্রথমে আমরা মুক্তারপুর, রামপাল, মহাকালীসহ আশপাশ এলাকায় যুদ্ধ শুরু করলাম। দিনে স্থানীয় জনগণের বাড়িত খেতাম এবং রাতে বিভিন্ন বাড়িতে আমরা থাকতাম। জনগণের সহযোগিতা ছিল অনেক। জনগণের সহযোগিতার কারণেই আমরা যুদ্ধ করতে পেরেছি। আমি ছিলাম কমান্ডার। ফজলু, রহিম, আলিম, অনুসহ অনেকেই আমার সঙ্গে ছিল। আমরা রামপালের পানাম গ্রামের জঙ্গলের ভেতরে ক্যাম্প করি। সেখানে আমি প্রায় দেড় শ’ জনকে পর্যায়ক্রমে ট্রেনিং দিই। ট্রেনিং করিয়ে গ্রুপে ভাগ করে আমরা বিভিন্ন স্থানে অপারেশনে যাই। তখন আমাদের দলটি হয়ে গেল অনেক বড়। পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩০ জন আর্মি সদস্য এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের সঙ্গে ছিল মেশিনগান, মর্টারসহ সব ধরনের অস্ত্র। মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন হালিম তাদের মুন্সীগঞ্জে পাঠান। যে দেড় শ’ মুক্তিযোদ্ধাকে আমি ট্রেনিং করিয়েছি তাদের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর্মিরা উন্নততর ট্রেনিং করিয়ে পাকা মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করেন। তখন আমরা ২শ’জনের একটি বড় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপে পরিণত হই। গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলতে থাকল পাক হানাদার বাহনীর ওপর আমাদের আক্রমণ। সঙ্গে ছিল এসএলআর, স্টেনগান, রকেট লঞ্চার, গ্রেনেডসহ বিভিন্ন অস্ত্র। পরে ফজলে এলাহি ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় অস্ত্র, গুলি, মর্টার, হেভি মেশিনগান, এলএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্র আমাদের এনে দিয়েছিল। আমাদের ক্যাম্পটি তখন পরিণত হয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে। পরে আমরা মুন্সীগঞ্জের ইদ্রাকপুরের ফায়ার সার্ভিস ক্যাম্পসহ কয়েকটি সাব ক্যাম্প করেছিলাম। আমি ফায়ার সার্ভিস ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অপারেশনে পাঠাতাম। স্মৃতির পাতা উল্টে তিনি বলেন, ধলেশ্বরীর পাড়ে আমরা গাছের ডাল, লতা-পাতা শরীরে ও মাথায় বেঁধে এ্যামবুশ করে থাকতাম। আমাদের উদ্দেশ্য একটাইÑ নদীপথে আসা পাক হানাদারদের ওপর হামলা করব। আমরা যতগুলো পাক হানাদারদের ওপর হামলা চালিয়েছি প্রায় সব হামলাই করেছি এ্যামবুশ থেকে। একদিন খবর পাই পাক হানাদার বাহিনী মুক্তারপুর-টঙ্গীবাড়ি সড়ক দিয়ে আসছে। যে কোন মুহূর্তে হামলা করতে পারে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা মুক্তারপুরের কাছে বানিয়াবাড়ি একটি ব্রিজ এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ভেঙ্গে ফেলি। পরে আর পাক সেনারা এই সড়ক ব্যবহার করতে পারেনি। রামপাল বিদ্যালয়ে পাক সেনারা ক্যাম্প করেছিল। সেখানে আমরা হামলা করতে যাই। সেখানে যাওয়ার পর স্থানীয় লোকজন খবর দিল এখন হামলা করলে মুন্সীগঞ্জই থাকবে না। কারণ মিরকাদিম ও কমলাঘাটে অসংখ্য গানবোট নিয়ে পাক সেনারা আসছে। আমরা সেদিন হামলা না চালিয়ে ফিরে আসি। আমার নেতৃত্বে পুরো বাহিনী নিয়ে শহরের উপকণ্ঠ রতনপুর পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিই। সহযোদ্ধাসহ আমরা চারদিক থেকে পাক হানাদারদের ঘিরে ফেলি। এক পর্যায়ে রতনপুরের কবরস্থানের একটি ভাঙ্গা কবরের মধ্যে ঢুকে কবরের ভেতর থেকেই গুলি ছুড়তে থাকি। সেই যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত হয় এবং আমরা জয়ী হই। পাকসেনাদের ওপর এমন অনেক সফল আক্রমণ আমরা চালিয়েছি। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর আমরা পাক বাহিনীর প্রধান ক্যাম্প হরগঙ্গা কলেজ চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। হামলা চালাই উপর্যুপরি। আমরা পাকসেনা ক্যাম্পে ফায়ার করি। গ্রেনেড ছুড়ে মারি। সেদিন মুক্তিযোদ্ধা আনিছুজ্জামান আনিস ব্রিজ থেকে রাতভর এলএমজি দিয়ে ফায়ার করেছিল। ফায়ার করেই আমরা সরে আসতাম। প্রথমে আমরা ছাত্রাবাস ঘেরাও করে রাখি। ভোর হওয়ার আগেই পাকবাহিনী ধলেশ্বরী পার হয়ে পালিয়ে যায়। ১১ ডিসেম্বর মুক্ত হয় মুন্সীগঞ্জ। আমি ছিলাম বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেয়া প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা। ভারতে ১নং বইতে ৫৭০ নাম্বার মুক্তিযোদ্ধা ভলিয়ম ওয়ানে। মুন্সীগঞ্জেও মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকায় প্রথমেই আমার নাম রয়েছে। তিনি পরে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করে ফেনী, ভোলা ও বগুড়ার এসপির দায়িত্ব পালন করেন। অর্জন করেন গৌরবোজ্জ্বল সুনাম। তাঁর সততা সকলকে আকৃষ্ট করে। প্রচারবিমুখ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি শহরের পুলিশ লাইনের বিপরীতে ইদ্রাকপুরে। তবে বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করছেন। ছিলেন পুলিশের ডিআইজি পদে, এখন অবসরে আছেন।
×