ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দীপক চৌধুরী

’৭১-এর গণকবর নৃশংসতার সাক্ষী

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

’৭১-এর গণকবর নৃশংসতার সাক্ষী

’৭১-এর অগণিত গণকবর ও বধ্যভূমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এ দেশের আনাচে-কানাচে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে আছে এসব গণকবর। দেশের অনেক আলোচিত-অনালোচিত গণকবরের তথ্য এখনও অজ্ঞাত। এর কিছু চিহ্নিত হলেও যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান সিলেট বিভাগের ১০৫টি গণকবর নিয়ে অনুসন্ধানমূলক কাজ করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে জানালেন, বিলের পাড়ে, নদীর কিনারায়, জঙ্গল, রেলওয়ে জংশনের পাশে ও খালের তীরে এ মাতৃভূমির জন্য আত্মত্যাগী মানুষের কবর রয়েছে। এছাড়া অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি এখনও চিহ্নিতই হয়নি। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে মানুষের হাড় ও কঙ্কাল। যারা এই ভূমি স্বাধীন করার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রাণ বিসর্জন দিলেন- আমরা কতটুকু স্মরণ করছি তাদের? ড. আবুল হাসানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গণকবর সম্পর্কে এ রচনা উপস্থাপন করা হচ্ছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকসেনারা ওইসব স্থানে শ’ শ’ বাঙালী নারী-পুরুষকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও বিভিন্ন বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। স্মৃতি রক্ষার্থে লাগানো হয়নি সাইনবোর্ডও। ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত থাকা অবস্থায় ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের গণকবর নিয়ে কাজ করেছেন ও করছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘এমনও পেয়েছি গণকবরকে শৌচাগার বানানো হয়েছে যা লজ্জাজনক। এ এক তিক্ত অভিজ্ঞতা।’ সিলেটে কর্মরত থাকাকালে সরকারী বন্ধের দিন বেছে নিয়েছিলেন এই অনুসন্ধান কাজে। এক শ’ পাঁচটি গণকবরের সন্ধানে কাজ করতে গিয়ে অচেনা ও দুর্গম পথে কঠিন পরিস্থিতির মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নানা উদাহরণ দিয়ে ড. আবুল হাসান জানালেন, বৃহত্তর সিলেটের ৩৮টি উপজেলার বিভিন্ন গণকবরের চিত্র ধারণ করেছেন ক্যামেরায়। ১০৫টি গণকবরের মধ্যে প্রায় ৬০টি এখনও স্মৃতিচিহ্নহীন, ২০টির জায়গা অনুমান করা ছাড়া সঠিকভাবে নিরূপণ হয়নি, ২২টি মোটামুটি লোকজন ভাল চেনে ও স্মৃতিচিহ্ন বোঝা যায়, তিনটি সুন্দরভাবে নির্মিত। একটি ইতিহাসভিত্তিক বই রচনা করার পরিকল্পনাও তার আছে। সিলেট বিভাগে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে তিনি যেসব গণকবরের সন্ধান পেয়েছেন এসবের মধ্যে অন্যতম যেটি অবহেলিত তা হচ্ছে- সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। মূলত কোম্পানীগঞ্জে দুটি গণকবর রয়েছে। একটি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরে, যার নাম ‘টুকেরবাজার গণকবর’ যা সামান্য একটু স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে চিহ্নিত। আরেকটি হলো ‘গৌরীনগর গ্রামের গণকবর।’ এ গণকবরটি চলতি বছরের ৫ আগস্ট শুক্রবার পরিদর্শন করেন। তার বর্ণনা- এটি হলো সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের দক্ষিণ প্রান্তে। পেছনে ছোট্ট একটি খালের মতো দেখা যায়, যা বর্ষার পানিতে ডুবে আছে। এরই দক্ষিণ পাশে বাঁশঝাড়। পরম যতেœ ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে সাত শহীদের কবর। এখানে যে একটি গণকবর রয়েছে তার হদিস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোন ইতিহাসেই লিখিত আছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় জনসাধারণের মুখ থেকে জানা যায় যে, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানী সেনাদের আগমনের কথা জানতে পেরে মুক্তিসেনারা গৌরীনগর গ্রামের সামনে কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট সড়কে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেখানে পাক-বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেদিন পাকিস্তানী সেনারা সামনে এগোতে ব্যর্থ হয়ে সিলেট ফিরে যায়। তবে এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে আরও ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুনরায় নবেম্বর মাসের এক কুয়াশা ছুঁই-ছুঁই সকালে ওই গ্রামে প্রবেশ করে। নির্মমভাবে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হান্নানের পিতা আবদুল গফুরও ছিলেন। সেদিন এই শহীদদের লাশ দাফন করার সাহস ছিল না গ্রামবাসীর। আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছিল তাদের প্রতি মুহূর্ত; এই বুঝি ‘পাঞ্জাবীরা’ আবার এসে পড়ল! ভয়ে ভয়ে শহীদদের আত্মীয়-স্বজনরা ওই লাশগুলো একটি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এ গণকবরে যারা শায়িত রয়েছেন তাদেরও রক্ত মিশে আছে বাংলাদেশের পতাকায়। কিন্তু সেই গ্রামে একদিন যে হানাদারের বুলেটের আঘাতে মানবপ্রাণের রক্ত ঝরেছিল তার কোন স্মারক ফলক বা স্মৃতিচিহ্ন নেই। নাই বা রইল ইট-পাথরে ঘেরা স্মৃতিচিহ্ন। সেখানে যেন বাঁশঝাড়ই স্বর্গের শীতল পরশ দিয়ে আগলে রেখেছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ সদরে গৌরীনগর বাজার। সরেজমিন গণকবরের অবস্থা দেখতেই সেখানে যাওয়া। একসময় প্রাকৃতিক কাজের প্রয়োজন দেখা দিলে স্থানীয়দের দেখানো জায়গায় গিয়ে অবাক হলেন ড. আবুল হাসান। দুটি দোকানের মাঝখানে সরু একটি রাস্তা। সামনে তিনটি ‘পিলার’। কিন্তু তার বিস্ময় এখানেই- গণশৌচাগার করা হয়েছে শহীদদের কবরে! এই বধ্যভূমির চিহ্ন হিসাবে একটি সীমানা প্রাচীর পর্যন্ত নির্মিত হয়নি। বিভিন্ন গণকবরের আশপাশের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, রাজাকারদের সহযোগিতা ছাড়া পাক-বাহিনীর পক্ষে হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হতো না। কিছু এলাকায় সংখ্যার সঠিক হিসাব অনেকেই পরিষ্কার জানেন না। তবে তৎকালীন প্রত্যক্ষদর্শী যারা বেঁচে আছেনÑ তারা দেখেছেন, পাকসেনারা অভিযানে যাওয়ার সময় বিভিন্ন নদী ও বিলের দিকে তাকিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া শ’ শ’ বাঙালী নারী-শিশু-পুরুষকে দেখে গুলি চালাত। এ সময় তারা মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে মানুষ হত্যা করত। বাঙালী নিধনযজ্ঞ ছিল তাদের কাছে আনন্দের, নিষ্ঠুর রসিকতা। বিশেষ করে হিন্দু নারী-শিশু হত্যার চেয়ে তাদের কাছে বড় আনন্দ আর কিছু ছিল না। স্থানীয় অধিবাসীরা জানান, কত লাশ মাটিচাপা দিয়েছি তার কোন হিসাব নেই। আরও একটি গণকবরের কথা বলছি। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের পাশের গণকবরের কাহিনী। ‘ইউএনও কমপ্লেক্স’-এর পাশেই থাকা এ গণকবরের রোমহর্ষক কাহিনীর প্রচার থাকলেও বাস্তবে কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই এর। একটির নাম জাঙ্গালহাট গণকবর। এটি মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের আরেকটি গণকবর। জৈন্তাপুর উপজেলায় এর অবস্থান। জাঙ্গালহাটি গ্রামে জৈন্তাপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় সংলগ্ন এটি। একই কবরে শায়িত আছেন দুই বন্ধু : আলতাফ উদ্দীন আহমেদ ও রাশিক উদ্দীন আহমেদ। ’৭১-এর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকের ঘটনা। আলতাফ হোসেন ছিলেন জৈন্তাপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। আর রাশিক উদ্দীন আহমেদ পড়াশোনা করতেন না, তবে উভয়েরই বয়স ছিল তেরো-চৌদ্দ বছর। সমবয়স্ক থাকার কারণে তারা ছিল একে অপরের খেলার সঙ্গী। আলতাফ উদ্দীনের বড় ভাই সিরাজ উদ্দীন আহম্মেদ ছিলেন জৈন্তাপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি পরিবারসহ ভারতে চলে গেলেও তার চঞ্চলমতি ছোট ভাইটি বাবা-মাসহ দেশেই থেকে যায়। রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের চিনিয়ে দেয় আলতাফকে। স্বাধীনতাবিরোধীদের দেখানো মতে পাকিস্তানী সেনারা তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করতে আসে। আলতাফ ও তার বন্ধু রাশিক এতে বাধা দিলে রাজাকাররা তাদের ধাওয়া করে। প্রাণের ভয়ে দৌড়েও তারা রেহাই পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে। শেষপর্যন্ত রাজাকাররা তাদের ধরে ফেলে এবং হানাদারের হাতে তুলে দেয়। হানাদাররা তাদের কয়েকদফা নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে পরে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে দুই বন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শহীদদের আত্মীয়-স্বজন তাড়াহুড়ো করে প্রাণের ভয়ে কোন রকমে একই কবরে ঢালাও মাটি ফেলে দাফন করে। কবরটির চারদিকে ইটের বেড়া দেয়া হলেও যত্নহীন পড়ে আছে। যা ভগ্নপ্রায়। কবরসংলগ্ন বিশাল একটি গাছ বেড়ে উঠেছে। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার গঙ্গানগর গণকবরের কথা স্থানীয়দের মুখে মুখে ফিরে। লোকমুখে শোনা যায়- স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর পর স্থানীয় এক ব্যক্তি বাড়ি নির্মাণের জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে নারী-পুরুষের হাড়গোর পায়। বিষয়টি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে- ‘৭১-এর পাকিস্তানী সেনারা বাঙালীদের হত্যা করে এখানে গণকবর দিয়েছিল। এসব হাড় শহীদদের। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, হাড়গোরগুলো স্থানান্তর করে ওই বাড়িওয়ালা বাড়ির শৌচাগার নির্মাণ করেছে এখানে। অথচ কেউ নাকি প্রতিবাদ করেনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আর তাঁর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত চেষ্টা ও আন্তরিকতায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানী ভাতাসহ সকলক্ষেত্রেও সম্মানিত হচ্ছেন। গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণেও সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। এ জাতি বিশ্বের ইতিহাসে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার কৃতিত্ব রাখে। কিন্তু একইসঙ্গে এ প্রশ্নটিও আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে না কেন- স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যেভাবে বীরত্ব দেখিয়েছি, নিজেদের সেই কৃতিত্বকে ধরে রাখতেই গণকবর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তো আমাদেরও নিতে হবে। এ দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, সবার। লেখক : সাংবাদিক
×