ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

পত্র-পত্রিকায় বিজয়ের খবর

সারাবিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

সারাবিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশ

মোরসালিন মিজান ॥ একটি অসম যুদ্ধ। একদিকে পাকিস্তানের দক্ষ প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, অন্যদিকে বাংলার সাধারণ কৃষক শ্রমিক মুটে মজুর। এর পরও সারাবিশ্বের বিস্ময় হয়ে সামনে আসে বাংলাদেশ। নয় মাসের সংগ্রামে পরাস্ত করে বর্বর পাকিস্তান বাহিনীকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় সোনার বাংলা। বাঙালীর আশ্চর্য অর্জনের খবর পরদিন ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বহু পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ভারতসহ তখনকার ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোও বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে-বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছিল। এসব কারণে মহান বিজয়ের খবর আর কেবল বাঙালীর হয়ে থাকে না। বিশ্বগণমাধ্যম এ সংবাদ ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে। সে সময়কার পত্রিকাগুলো এখন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মারক। দুর্লভ এসব পত্রিকায় বাঙালীর ঐতিহাসিক বিজয়ের দিনটি নানা ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়। রিপোর্টগুলো যেমন আবেগে ভাসায়, তেমনি তুলে ধরছে অজানা অল্পজানা ও ভুলে থাকা ইতিহাস। গত বেশ কিছুদিন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিল ও আর্কাইভ ঘেঁটে দেখা যায়, যুদ্ধের খবর প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে আসছিল দেশীয় পত্র-পত্রিকাগুলো। বিদেশী গণমাধ্যমেও বিশেষ গুরুত্ব পায় প্রতি দিনের যুদ্ধ সংবাদ। সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের যুদ্ধ জয় এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের খবর হৈচৈ ফেলে দেয় বিশ্বগণমাধ্যমে। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশসহ অধিকাংশ দেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের খবরটি প্রধান সংবাদ শিরোনাম করা হয়। কোন কোন দৈনিকের পুরোটাজুড়েই ছিল যুদ্ধ জয়ের খবর। অন্য পত্রিকাগুলোতে একাধিক স্টোরি ছাপা হয়। এদিনের প্রায় সব পত্রিকার পাতায় বড় করে ছাপা হয় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ছবি। দেশীয় পত্রিকাগুলোর সংবাদ শিরোনামে বিশেষ প্রাধান্য পায় ঐতিহাসিক সেøাগান ‘জয় বাংলা’। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া দেশগুলো সংবাদটি পরিবেশন করে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। পরাজয়ের গ্লানি এবং হাতাশার চিত্র ফুটে ওঠে ওই সব দেশের একাধিক পত্রিকার খবরে। কিছুটা ঘুরিয়ে বলার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বাঙালী নিধনে নামা পাকিস্তানীরা তো পরাজয় মানতেই চাইছিল না। অন্তরালের সেই খবর দেশটির পত্রিকা ঘেঁটে দিব্যি পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে বেশকিছু পত্রিকা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। দুর্লভ কিছু পত্রিকা এখনও বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার পত্রিকাগুলো সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। তাই রাজধানী থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বিজয় দিবসের খবর খুব কমই পাওয়া যায়। ওই দিন ক’টি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তারও কোন সঠিক তথ্য কোথাও নেই। তবে বিখ্যাত ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকাটি বিজয়ের খবর দিয়েছিল ‘দৈনিক বাংলা’ নামে। পত্রিকার মাস্ট হেডে পাকিস্তান শব্দটির গায়ে ক্রসচিহ্ন এঁকে দেয়া হয়। নতুন করে লেখা হয় ‘বাংলা’ শব্দটি। পত্রিকার এই কপিটি বারবার দেখা। এখনও সর্বত্র অনুলিপি পাওয়া যায়। পত্রিকাটির ৮ কলামে লিড করা হয় বাঙালীর বিজয়ের সংবাদ। শিরোনাম ছিল ‘জয় বাংলার জয়’। মূল ছবিতে দৃশ্যমান হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘আজাদী’ পত্রিকারও পুরোটাজুড়ে ছিল নতুন বাংলাদেশের খবর। যুদ্ধ জয়ের খবরটি লাল কালিতে ব্যানার হেডলাইন করে পত্রিকাটি। ঐতিহাসিক সেøাগান থেকে শিরোনাম করা হয় ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। মূল খবরে আবেগঘন উচারণ। সেখানে লেখা হয়- ‘জয় বাঙলা। বাঙলার জয়। বাঙলার জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের সকল আশা আকাক্সক্ষা এই একটিমাত্র জয়ধ্বনিতে ভাষা পাইয়াছে। দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানবাদী জল্লাদ গোষ্ঠীর খঞ্জর বাঙালীর রক্তে লাল হইয়াছে। বার বার মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার বীর জনতার বুকের রক্তে লাল হইয়াছে পদ্মা মেঘনা যমুনার জল। কর্ণফুলী বুড়িগঙ্গার জল। জল্লাদেরা ইসলামের ভাওতা দিয়া পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির দোহাই দিয়া আকণ্ঠ পান করিয়াছে বাঙালীর বুকের রক্ত।’ বহু দিনের পুরনো এই দৈনিকে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি মাঝখানে আলাদাভাবে করা হয়। বক্স আইটেমের শিরোনাম ছিল ‘মুক্তি ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট বাংলা দেশ দখলদার পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ’। এতে লেখা হয়, ‘পাকিস্তানের স্বঘোষিত সৈনিক প্রেসিডেন্ট নরপশু জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ সেনাবাহিনী লক্ষ লক্ষ নিরীহ বাঙ্গালীকে হত্যা করার পর বীর বাঙ্গালী নওজোয়ান ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর তীব্র প্রতি আক্রমণের মুখে ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া আত্মসমর্পণ করিলে বাংলাদেশে ১৫ দিন স্থায়ী যুদ্ধের অবসান ঘটে। ফলে রক্ত-ক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটে। এবং বিশ্বের মানচিত্রে বাংলা দেশ স্থায়ী আসন লাভ করে।’ বিজয়ের দিনে অবিসংবাদিত নেতা ও তার ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংবাদটিতে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশের নয়ণমনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গ বন্ধু শেখ মজিবর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানেই বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন।’ বন্ধু রাষ্ট্র ভারত থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো সে দেশের মানুষের আবেগ ভালবাসাকে ধারণ করেছিল। ১৭ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি প্রধান শিরোনাম করে। বিখ্যাত দৈনিকের মূল শিরোনাম ছিল- ‘পাকিস্তান হার মানল, নিয়াজির বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ’ শিরোনামে পত্রিকাটি লেখে- ‘বাংলাদেশে দখলদার পাক ফৌজ বৃহস্পতিবার আত্মসমর্পণ করেছে। এবং আত্মসমর্পণ করেছে বিনাশর্তে। ঐ ফৌজের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজি আত্মসমর্পণের শর্তাদি নিয়ে আলোচনার জন্য ইস্টারন কমানডের অধ্যক্ষ মেঃ জেঃ জেকবকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল জেকব তদনুযায়ী বৃহস্পতিবার সকালেই হেলিকপ্টারে ঢাকা রওনা হয়ে যান। এই সম্পর্কে নয়াদিল্লি থেকে প্রকাতি এক সরকারী ঘোষণায় বলা হয়েছে ঃ জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আজ সকালে লেঃ জেঃ নিয়াজি তাতে সাড়া দেন।’ এই সংবাদে আরও জানানো হয়, জেনারেল মানেকশ আত্মসমর্পণের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছিল বৃহস্পতিবার সাকল ৯টা।’ একই দিন কলকাতা থেকে প্রকাশিত যুগান্তর পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ‘নিয়াজির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’। রিপোর্টে লেখা হয়, ‘পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী আজ বিনাশর্তে মুক্তিবাহিনীর সহযোগী ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পূর্ণ মুক্তি লাভ করলো।’ সংবাদে তথ্য দিয়ে বলা হয়, ‘পাক দখলদার বাহিনীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের কথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ঘোষণা করেন এবং রাজ্যসভায় এই কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম। বিকাল সাড়ে পাঁচটার সময় উভয় কক্ষে একই সঙ্গে এই ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই উভয় কক্ষ উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং নির্দিষ্ট সময়সূচীর বাইরেও তারা অধিবেশন চালিয়ে যান।’ ভারতের চ-ীগড় থেকে প্রকাশিত ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় লিড ছিল বাংলাদেশের বিজয়ের খবর। শিরোনাম ‘BANGLADESH FREED, UNCONDITIONAL SURRENDER BY PAK TROOPS. বিশ্বের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি মূল সংবাদ করে। হেডলাইন ছিল, ‘ওঘউওঅ ঙজউঊজঝ ঈঊঅঝঊ-ঋওজঊ ঙঘ ইঙঞঐ ঋজঙঘঞঝ অঋঞঊজ চঅকওঝঞঅঘওঝ ঝটজজঊঘউঊজ ওঘ ঞঐঊ ঊঅঝঞ’. সংবাদের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষররত নিয়াজী ও অরোরার ঐতিহাসিক ছবিটি সংযুক্ত করা হয়। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকেও বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর দেয়া হয়। প্রভাবশালী দৈনিক নেভাডা স্টেট জার্নালের ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রধান সংবাদ হয়ে আসে বাংলাদেশ। পত্রিকাটি প্রথম পাতায় বেশ কয়েকটি স্টোরি করে। বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি দেয় ‘ইধহমষধফবংয চৎড়পষধরসবফ অং ঘধঃরড়হ’ শিরোনামে। উল্লেখযোগ্য দৈনিক ‘দি সল্টলেক ট্রিবিউন’র প্রধান সংবাদ ছিল ‘Indians Enter Dacca, ExtendTruce to West’. পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোতেও আসে বাংলাদেশের বিজয়ের খবর। যতটা সম্ভব ঘুরিয়ে তারা এই খবর প্রকাশ করে। নাকে খত দিয়ে পাকিস্তানী আর্মি যখন প্রাণ বাঁচানোর আকুতি করছে তখন ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক ডন পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ‘War till Victory’. মূল সংবাদের নিচে ছোট করে মাত্র দুই কলামে দেয়া হয় বাংলাদেশের বিজয়ের খবরটি। পরাজয় মেনে নিতে নারাজ পাকিরা তাদের নিজেদের মতো করেই হেডলাইন করে- ‘Fighting ends in Est Wing. PAF Hits in WestÕ. এভাবে বিজয়ের শুভক্ষণে সারাদুনিয়ার গণমাধ্যমের নজড় কাড়ে বাংলাদেশ। অন্যসব খবর পেছনে পড়ে যায়। স্থানীয় আন্তর্জাতিক খবর পেছনে ফেলে সর্বাধিক গুরুত্বের বিষয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের বিজয়গাথা। দীর্ঘ ৪৫ বছর পর পত্রিকাগুলো ঘেঁটে আবেগাক্রান্ত হয়ে ওঠে মন। ইতিহাসের অমূল্য স্মারক বাঙালীর বীরত্বের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।
×