ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চক্ষু মেলিয়া ॥ নিয়ামত হোসেন

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬

চক্ষু মেলিয়া ॥ নিয়ামত হোসেন

৭-এ নেয়া, ফেরত ৭০-এ একটি লাইব্রেরি থেকে পড়ার জন্য একখানা বই নিয়েছিলেন। বই তিনি ফেরত দিলেন ৬৩ বছর পরে। বইটি পেয়ে গ্রন্থাগারিক অবাক। খবরটি মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে। ঘটনাটি ঘটেছে ব্রিটেনের নরফোক এলাকায়। সেখানে এক স্কুলে পড়ার সময় এক স্কুল বালিকা রবার্ট লুই স্টিভেনসন রচিত ‘ট্রাভেলস উইথ এ ডাংকি ইন সেভান’ বইটি পড়ার জন্য নিয়ে ছিলেন। পড়েই সেটি লাইব্রেরিতে ফেরত দেয়ার কথা। সেটা ছিল ১৯৫৩ সাল কিন্তু সেই ৫৩ সাল কবেই পার হয়ে গেছে বইটি আর ফেরত দেয়া হয়নি। এই সেদিন বাড়ির বইয়ের আলমারি গোছাতে গোছাতে তিনি দেখলেন সেই বইটি। আহা এ কি কা-! বইটি ফেরত দেয়া হয়নি! ফেরত দেয়ার কথা সেই ৫৩ সালে, সেই কিশোরী বয়সে। এখন যে তিনি বৃদ্ধ কী মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে কিন্তু ভুল শুধরাতে হবে। তিনি ১৯৫৩ সালের বই যেখান থেকে এনেছিলেন এই সেদিন সেখানে ফেরত দিয়ে এসেছেন। বইটি খুঁজে পেয়ে তিনি যেমন বিস্মিত, ফেরত দিতে পেরে যেমন আনন্দ পেয়েছেন ঠিক তেমনি বিস্মিত হয়েছেন গ্রন্থাগারিক নিজেই। ঘটনাটি তাই খবর হয়েছে বিশ্ব মিডিয়ার। মহিলাটি যে ভুলো মনের তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি বইটি ফেরত দিয়ে কাজটি ভাল করেছেন। সে কথাও বলা যায়। বই থাকে লাইব্রেরিতে। সবার পড়ার জন্য। কিন্তু সে বই পড়ার জন্য নিয়ে আটকে রাখলে তাতে অন্যদের ক্ষতি হয়। যাই হোক, ওই ভদ্র মহিলা বালিকা বয়সে নেয়া বই যে বৃদ্ধ বয়সে ফেরত দিলেন এমন কাজ অনেকেই করেন না। আমাদের এমন অনেক লাইব্রেরি আছে বা ছিল যেগুলোর বহু বই বহুজনেই লোপাট করে দিয়েছেন। পড়ার জন্য নিয়েছেন তার পর পড়েছেন কি পড়েননি সেটা তিনি জানেন। তবে সেটা ইহ জীবনের জন্য গায়েব করে দিয়েছেন। এ দেশে গ্রামে-গঞ্জে, পাড়ায় পাড়ায় অনেক পাঠাগার বা লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল এগুলোর অস্তিত্ব তেমন আর নেই। আজকাল অনেকেই আর বই পড়েন না। বঙ্কিম চন্দ্রের ভাষায় একটু ঘুরিয়ে বলা যায় ‘বই তোমার দিন গিয়াছে’। আজকাল হয়েছে কম্পিউটার ইন্টারনেট। লোকে এখন টিপ দিলেই পেয়ে যাবেন দেশী-বিদেশী নানা সাহিত্যের বই। পেয়ে যাচ্ছেন নানা তথ্য। যারা পড়ার, তারা ঠিক পড়ছেন, যাদের সাহিত্যের ব্যাপারে আগ্রহই নেই তারা না পড়ছেন কাগজে ছাপা বই। না পড়ছেন কম্পিউটারের বই। এটা একটা দিক। অন্য দিকটি হচ্ছে যাদের কম্পিউটার নেই তারা কি করবে। তাদের হাতের কাছে কাগজের বই অত্যন্ত জরুরী। এটা যেমন ছোটদের ব্যাপারে সত্য, তেমনি সত্য বয়স্কদের ব্যাপারেও। এক কালে দেখা যেত স্কুলের কিশোর-কিশোরীরা হাতের কাছে কোন লাইব্রেরি থাকলে সেখান থেকে বই পড়ার জন্য নিয়ে যেত, সে বই গো গ্রাসে গিলত। গল্পের বই- সে ডিটেকটিভই হোক বা অন্য কোন বই-ই হোক। নিজে পড়ত, বন্ধুকে পড়াত। বয়স্করা বিকেলে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখের সামনে খুলে ধরতেন কোন উপন্যাস বা কোন প্রবন্ধের বই তাতে জ্ঞান চর্চাও হতো সময়ও কাটত। কিন্তু কোথায় সে দিন কোথায় সেই বই, আর কোথায় সেই পাঠাগার। দেশের কোন কোন এলাকায় এখন কিছু পাঠাগার আছে কিছু পাঠকও আছেন যারা নিয়মিত বই পড়েন জ্ঞান চর্চা করেন কিন্তু এটাই সামগ্রিক চিত্র নয়। দেশের বহু স্থানে স্কুল হয়েছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখছে কিন্তু হাতের কাছে, এরা সবাই পাঠাগার পাচ্ছে কী? প্রতিটি স্কুলে পাঠাগার আছে কী? তাহলে এরা কী স্কুলের বাইরে বই পড়বে না, জানবে না দুনিয়াকে? সবার হাতে তো কম্পিউটার নেই! এদের অবসর কাটছে কিভাবে? পাঠাগার আন্দোলন বলে একটা কথা আগে শোনা যেত এখন শোনা যায় না। রাজধানী ঢাকা শহরে কত পাড়া কত আবাসিক এলাকা! কয়টা পাড়ায়, কয়টা আবাসিক এলাকায় পাঠাগার আছে? এখানে যে সব এলাকায় পাঠাগার আছে বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে লোক এসে সে সব লাইব্রেরির বই পড়া কী সম্ভব? এখানে এখন ছেলেমেয়েরা অধিকাংশই বড় হচ্ছে ‘পাঠাগার’ ছাড়া, বই ছাড়া, সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়া। লেখাপড়া করার উদ্দেশ্য শুধু কি পাস করা, পাস করে চাকরি খোঁজা? দুটোরই প্রয়োজন আছে কেউ তা অস্বীকার করবে না। কিন্তু আর একটি প্রয়োজন আছে পাঠাগারের বইয়ের। পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার, পাড়ায় পাড়ায় বই বাংলা সাহিত্যের বই এবং বিশ্ব সাহিত্যের বই। এগুলোই তাদের জন্য জরুরী। এসব ছাড়া শিক্ষা কী সম্পন্ন হবে! না হবে না। সেলফি তুলতে গিয়ে... সেলফি তোলা এখনকার তরুণ-তরুণীদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় বিষয়। যে যেভাবে পারছে, যেখানে পারছে একটু ইচ্ছে হলেই তুলে নিচ্ছে একটা সেলফি। এসব সেলফি তুলতে গিয়ে অনেক মজার ঘটনাও যেমন ঘটে, তেমিন ঘটে দুঃখজনক ঘটনাও। ঠিক তেমনই এক ঘটনা ঘটেছে কয়েকদিন আগে এক জাদুঘরে। পর্তুগালের লিসবন শহরের জাতীয় জাদুঘর। বহু দর্শকের আগমন ঘটে সেখানে। লোকজন আসছে-যাচ্ছে, নানা প্রাচীন সামগ্রী দেখছে। এক পর্যটক সেদিন ওই জাদুঘরে গিয়েছিলেন পুরাকীর্তি দেখতে। তিনি এটা দেখছেন, ওটা দেখছেন, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা চমৎকার ভাস্কর্য তিন শ’ বছর আগেকার। চমৎকার ভাস্কর্র্য। যে কোন লোকেরই চোখে পড়ার মতো। ঐ ভদ্রলোক ভাস্কর্র্যটি দেখে মুগ্ধ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বের করলেন তার মোবাইল ফোন। ভাস্কর্যটির সঙ্গে সেলফি তুলতে হবে। ভাস্কর্যটির দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন সেটার পাশে। ক্যামেরা বাগালেন। কায়দা করে সেলফি তুলতে গেলেন। তোলাও হলো এবং তার ঘোরাঘুুরি ও নড়াচড়ার কারণে ভাস্কর্যটি স্থানচ্যুত হয়ে পড়ল মেঝেতে। পড়ামাত্র চুরমার! সঙ্গে সঙ্গে কাছে এলো আশপাশের দর্শকরা। ছুটে এলেন জাদুঘরের লোকজন। এমন প্রাচীন মূল্যবান পুরাকীর্তি ভাঙ্গার ঘটনাটির খবর বের হলো অনলাইন মিডিয়ার কাগজে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে এটুকুই। জাদুঘরের সম্পদের ক্ষতি করার কারণে লোকটির কি সাজা হয়েছে কিংবা আদৌ হয়েছে কিনা, তা জানা যায়নি। পুরাকীর্তি তথা পুরনো আমলের জিনিসপত্র জাদুঘরে রাখা হয়। লোকজনের দেখার জন্য, শেখার জন্য, আগের সমাজে আগের যুগে মানুষেরা কী ব্যবহার করত। কেমন ছিল তাদের জীবনযাত্রা এসব জানানোর জন্য। যে কারণে জাদুঘরের কোন সামগ্রী নষ্ট হলে সেটা সবার ক্ষতি। একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় জাদুঘর মানুষই স্থাপন করে। সেখানে বর্তমান কালের মানষের জন্য এবং ভবিষ্যতেরমানুষের দেখার জন্য। এমনি করে যুগে যুগে দেশে দেশে বহু জাদুঘর এমন কি ঘরের বাইরে বহু পুরাকীর্তি বা প্রাচীন আমলের নিদর্শন সংরক্ষণ করা হয়েছে। এক শ্রেণীর সুস্থ স্বাভাবিক সৎ মানুষ এগুলো করে, অন্যদিকে আরেক ধরনের দুর্বৃত্ত গোছের মানুষ, মদমত্ত ক্ষমতাধর মানুষ এগুলো লুটপাট করে, ধ্বংস করে। আগের যুগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে, এ যুগেও হচ্ছে। বিশ্বের বহু প্রাচীন আমলের জাদুঘর, নিদর্শন লুটপাট করা হয়েছে এ কালেও। এরা ধ্বংস করেছে অনেক কিছু। পুড়িয়েছে বই পত্র। এ প্রসঙ্গে সবার আগে বলা যায় হিটলারের নাম। তার আমলে বার্লিন শহরের রাস্তায় পোড়ানো হয়েছে বই। এর আগে এবং পরে কত দাম্ভিক মূর্খ যে কত কালের কত সমৃদ্ধ জাদুঘর ধ্বংস করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা বোঝেনি বর্তমান মানুষের এগিয়ে চলার পথে জাদুঘর তথা পুরাকীর্তি এবং বইপত্রের ভূমিকা কত বড়!
×