ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চার দেশের ইকোনমিক করিডরের ভবিষ্যত অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চার দেশের ইকোনমিক করিডরের ভবিষ্যত অনিশ্চিত

হাসান নাসির ॥ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার হয়ে পূর্বমুখী হতে চায় বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে স্থাপিত হচ্ছে টেকনাফ সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ। সংযুক্ত হতে হাত বাড়িয়ে আছে চীন। কানেক্টিভিটি হতে পারে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া পর্যন্ত। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের কোন সমস্যা নেই, বাংলাদেশেরও অন্য কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট সামনে এসে দাঁড়িয়েছে উটকো ঝামেলা হিসেবে। অনিশ্চয়তার দোলাচলে পড়েছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের (বিসিআইএম) ইকোনমিক করিডরের ভবিষ্যত। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গা নিয়ে। আরাকানে সক্রিয় কিছু সশস্ত্র সংগঠনের সন্ত্রাসী তৎপরতায় শুধু নারী-শিশুসহ নিরীহ রোহিঙ্গারাই নির্যাতিত হচ্ছে না, নেতিবাচক রেখাপাত হয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কে। অথচ এই দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের ভিত্তি ঐতিহাসিক। স্বাধীন বাংলাদেশকে সপ্তম স্বীকৃতি দানকারী দেশ মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা)। ১৯৭২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। ১৯৭৩ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় বাণিজ্য চুক্তি। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন প্রতিক্রিয়াশীল সরকার সেই সম্পর্ককে আর এগিয়ে নেয়নি। বরং ওপারের রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোকে নানাভাবে সমর্থন দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম দফায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটে ১৯৭৮ সালে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আন্তঃযোগাযোগ সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে নেয়া হয় ইতিবাচক উদ্যোগ। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সকল বাধা তিরোহিত হয়; কিন্তু মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশের পূর্বমুখীতায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা চায় কী ॥ রাখাইনের রোহিঙ্গারা আসলে কী চায়? তাদের দাবি কী? রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ কিছু মানবাধিকার সংগঠন ও দেশ। কিন্তু রোহিঙ্গারা কিসের জন্য কথিত বিপ্লবে নেমেছে, তা উঠে আসছে না কোন মাধ্যমে। তাদের দাবি যদি হয় শুধুই নাগরিকত্ব ও সমঅধিকার, তবে তো অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না। এমন দাবি আদায়ে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুন হাতে নিলেই যথেষ্ট। নাগরিকত্বের দাবিতে পুলিশ ফাঁড়ি বা সেনাক্যাম্পে সশস্ত্র হামলা হতে পারে কি? সম্প্রতি এক রোহিঙ্গা নেতার একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। পাশে রাইফেল রাখা কালো পাগড়ি পরিহিত এই নেতার পাঁচ মিনিট ৮ সেকেন্ডের জ্বালাময়ী বক্তব্যে একটিবারের জন্যও আসেনি নাগরিকত্ব কিংবা সমান অধিকার নিয়ে রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার দাবি। আউন সান সুচি, মিয়ানমার সরকার এবং সে দেশের ভিন্নমতাবলম্বীদের কাফের আখ্যা দিয়ে জিহাদের আহ্বান জানিয়েছে এই নেতা। তাহলে সে দেশের সরকারের কী করা উচিত। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এই করুণ পরিনতির জন্য দায়ী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) মতো কিছু উগ্রবাদী সংগঠন, যারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। যে কোন দেশে একটি গোষ্ঠী পরিস্থিতি সৃষ্টি করলে এর ফল সকলকেই ভোগ করতে হয়। ইরাক-সিরিয়ায় যারা মারা পড়ছে তাদের সকলেই আইএস-দায়েশ নয়। কিন্তু ফল তাদেরও ভোগ করতে হচ্ছেÑ এটাই বাস্তবতা। যাদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের জন্য নিরীহদের এই ভোগান্তি তারা বাংলাদেশে এলে গ্রেফতার করে সে দেশের সরকারের হাতে তুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে যথার্থ মনে করছেন রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা ॥ রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে ভ-ুল হওয়ার উপক্রম ইকোনমিক করিডর, আঞ্চলিক যোগাযোগ, বাণিজ্য সম্পর্ক সুদৃঢ়করণসহ অনেক পরিকল্পনা। মিয়ানমারে দীর্ঘ প্রায় সাত দশক পর এসেছে নির্বাচিত সরকার। অবরুদ্ধ এ দেশটির ওপর নজর পড়েছে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর। সম্পর্ক ক্রমশ উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করার ইচ্ছা ভারতের দীর্ঘ দিনের। এ নিয়ে আলোচনা এবং পরিকল্পনাও কম হয়নি। শেষ পর্যন্ত নানান রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে তা বিলম্ব হয়। সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত। সিটওয়ে (আকিয়াব) বন্দর হয়ে ভারতের আমদানি পণ্য প্রবেশ করবে সেভেন সিস্টার্স খ্যাত সাত অঙ্গরাজ্যে। অথচ দীর্ঘ প্রত্যাশিত খোলা হাওয়ার সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। অনাস্থা-অবিশ্বাসের স্পর্শকাতর ইস্যু রোহিঙ্গা। রাখাইন প্রদেশের কিছু উগ্রবাদী সংগঠনের তৎপরতায় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সুসম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে। অথচ এ সময়টি ছিল অপার সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়ার। অনিশ্চয়তায় বিসিআইএম ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ পূর্বমুখী হতে চাইলে মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল ২০০০ বছরের পুরনো সিল্ক রুট চালুর। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং এর ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। চীন সেই সিল্ক রুট পুনরুদ্ধার করতে চায়। এছাড়া আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর বাস্তবায়নের। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে চার দেশ। চীনের বেজিংয়ে ২০১৩ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় চার দেশের বৈঠক। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয় চার দেশের সম্মেলন। এতে বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর প্রতিষ্ঠায় চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার। উদ্দেশ্য জ্বালানি সহযোগিতা, বাণিজ্য সহজীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, শুল্ক কমানো, সাংস্কৃতিক বিনিময়, নন-ট্যারিফ, বাধা দূর এবং সড়ক রেল ও সমুদ্রপথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনসাধারণের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন। এ চারটি দেশে বসবাস করে অন্তত ২৮০ কোটি মানুষ। বিশাল এক সম্ভাবনার হাতছানি। বিসিআইএম করিডর বাস্তবায়নে ২২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে প্রাক্কলিত হয় কক্সবাজার সম্মেলনে। এর সিংহভাগই দিতে প্রস্তুত চীন সরকার। প্রাথমিক লক্ষ্য ভারত হতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের আকিয়াব হয়ে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং পর্যন্ত। ভবিষ্যত লক্ষ্য এ করিডর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমার কিন্তু সে দেশে উগ্রবাদী রোহিঙ্গা সংগঠনের তৎপরতা আবির্ভূত হয়েছে প্রধান বাধা হিসেবে।
×