ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোহাম্মদ কামরুল হাসান

মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও আলোকচিত্র

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের তথ্য ও আলোকচিত্র

ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যত দিনের আলোক বর্তিকা। যা যুগ থেকে যুগান্তরে সকল প্রজন্মকে অন্ধকার থেকে আলোয় চলার প্রেরণা যুগিয়েছে। রসদ যোগায় অতীতদিনের স্মৃতিচারণায়। ইতিহাস কোন স্থির বিষয় নয়। নয় সুনির্দিষ্ট তারিখ ও বাস্তব ঘটনার সংগ্রহ মাত্র। বরং ইতিহাস আলো-আঁধারে ঢাকা এক রহস্যময় বিষয়। সেটা নতুন তথ্যের উদ্ভব হচ্ছে বলে নয়- বরং প্রতিনিয়ত আমাদের আবেগ-অনুভূতির যে পরিবর্তন তার প্রতিফলনেই বদলে যাচ্ছে ইতিহাসের অর্থ, বিশ্লেষণ ও অনুপ্রেরণা। প্রখ্যাত মার্কিন ইতিহাসনির্ভর চলচ্চিত্রকার কেন বার্নস এমনই উপলব্ধি করেন। মানুষ নানা মাধ্যম ও উপায়ে ইতিহাসকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেছে। ইতিহাস কখনও লিপিবদ্ধ হয়েছে কখনোবা উঠে এসেছে শিল্পীর চিত্রকলায়। সুর ও শব্দের ছন্দেও ইতিহাস সংরক্ষিত ও বর্ণিত হয়েছে। লিখিত ইতিহাসকেই আমরা বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ও সঠিক বলে বিবেচনা করি। তার আগের ঘটনাকে পূর্ব ইতিহাস হিসেবেই গণ্য করা যায়। ‘বিগ ব্যাঙ’ বা মহাপ্রলয়ের পর সময় গণনার শুরু। যা আজ থেকে ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগের ঘটনা। ইহুদী দিনপঞ্জিকা অনুযায়ী ইতিহাসের বয়স ৫৭৭২ বছর। যদিও বিজ্ঞানীদের দাবি তা কেবল মানব সচেতনতার সময়কালের শুরু। তবে গ্রীসের প্রথম অলিম্পিক আয়োজনের পর মানুষের প্রথম লিখিত ইতিহাসের পথ চলা শুরু। শতাব্দীকাল ধরে মানুষ ছাপার অক্ষরকেই সত্য জ্ঞান করত। কিন্তু কিছু পৌষ্যপ-িত যখন বিজয়ীর পৃষ্ঠপোষকতায় ইতিহাস বিকৃতির পথে হাঁটল তখন তা সত্যসচেতনদের মনে সন্দেহের উদ্রেক যোগাল। তবে আধুনিক যুগে ক্যামেরার আবিষ্কারের ফলে আলো-আঁধারে ছবিতে ইতিহাস মূর্ত প্রতীকরূপে উঠে এসেছে। যদিও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা এ ক্ষেত্রেও বড় বাধা ও ইতিহাস বিকৃতির হাতিয়ার হিসেবে গণ্য। যে কোন জাতির কাছে তার অতীত ইতিহাস কখনও গৌরবের কখনোবা পরাজয়ের। কখনও আনন্দের কখনও বেদনার। তবে পূর্ব বাংলার পঁচিশ বছরের ইতিহাস কেবল বঞ্চনার। অন্যায়, শোষণ ও নিষ্ঠুর বর্বরতার। যা উঠে আসে সাদা-কালো ইমেজে। ছবির বেদনায় ও ভাষায়। যা আমাদের ইতিহাসের এক নির্ভরযোগ্য উপাদান ও উপাত্ত এবং তা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। গদ্য কিংবা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে যতটুকু খুঁজে পাওয়া যায় তার চেয়ে বেশি অভিব্যক্তি ফুটে উঠে ক্যামেরার ছবিতে। প্রতিটি ইমেজ যেন এক একটি গল্প। নতুনভাবে আবিষ্কার করা মুক্তিযুদ্ধ। অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে পঁচিশ বছরব্যাপী প্রতিরোধের চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৫২-১৯৭১ সালের দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় এসব ঘটনা উঠে এসেছে সাদা-কালো ইমেজে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘরসহ অসংখ্য বই ও পত্রপত্রিকায় দেখা যায় সংগ্রামী দিনের এমন অসংখ্য স্মৃতি। একাত্তরে বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকায়ও কিছু বিরল ছবির দেখা মেলে। এসব ছবির অভিব্যক্তি শারীরিক ভাষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দুর্বার দিনের কথা ও আত্মত্যাগ। যুদ্ধের প্রথম প্রহরে বিদেশী সাংবাদিকদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয় ঢাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। নিরাপত্তার কারণে সেই কালরাতের ছবি তুলতে তারা ব্যর্থ হন। ২৬ মার্চ সকালে নিরাপত্তা কিছুটা শিথিল হলে তারা দেখতে পান ঢাকার রাস্তায় পড়ে থাকা অগণিত মানুষের মৃতদেহ। এমন বহু ঐতিহাসিক ছবি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রিক্সায় পড়ে থাকা সেই সব মানুষের নিথর দেহ। ঢাকার রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামার কিছু ছবিও বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। জায়গা করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তবে দুর্ভাগ্য চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধের কোন ছবি আমাদের সংগ্রহে বিরল। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে কর্মরত দুজন বিদেশী সাংবাদিকের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি এবং টেলিগ্রাফ পত্রিকার সায়মন ড্রিং। মার্ক টালি ছিলেন বিখ্যাত ব্রিটিশ টিভি চ্যানেল বিবিসির সংবাদদাতা। তবে অপারেশন সার্চ লাইটের খবর বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে সায়মন ড্রিংএর সংবাদের মাধ্যমে। এন্থনি মাসকারেন্সের নামও এখানে উল্লেখ্য। এদের প্রত্যেকেই ছিলেন সাংবাদিক। তারাও মুক্তিযুদ্ধের ছবি সংগ্রহ করেছিলেন এবং বিদেশে পাঠিয়ে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করেছিলেন। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়া কোটি শরণার্থীর বহু ছবি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী। সল্টলেক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া সেই অজস্র মানুষের চাহনি-মুখয়বে ফুটে ওঠে নিদারুণ অসহায়ত্ব। সুয়্যারেজের বড় পাইপে আশ্রয় নেয়া এসব মানুষের নিদারুণ আর্তনাদ ফুটে ওঠে ছবির ভাষায়। দেশ ছেড়ে যাওয়া হাজারো মানুষেরও বেশ কিছু ছবি পাওয়া যায়।নারী শিশু-বৃদ্ধ কি অবর্ণনীয় দুর্ভোগ শিকার করে সীমান্তে পাড়ি জমিয়েছেন এমন বহু আলোকচিত্রও পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায়। আলোকচিত্রের বাইরে একাত্তর নিয়ে বেশ কিছু ডকুমেন্টারি তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে মার্কিন চিত্রপরিচালক লিয়ার লেভিনের নাম উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিখ্যাত পরিচালক প্রয়াত জহির রায়হান স্টপ জেনোসাইড নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এসব তথ্যচিত্র আমাদের ইতিহাসের অংশ। তবে সবচেয়ে বেশি ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন লেভিন। তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ ছবিটি তার ধারণকৃত ফুটেজের অংশ বিশেষ। তারেক মাসুদের এক সাক্ষাতকারে জানা যায় লেভিন মোট ১৭ ঘণ্টা যুদ্ধের ফুটেজ ধারণ করেছিলেন এবং দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাদেশের কোন সরকার কিংবা ব্যক্তি ১৯৯৭ সালের আগে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তার পরও সেই ফুটেজ ও তথ্যচিত্র তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন এসব তথ্যচিত্র একটি জাতির ইতিহাসের অংশ। সযতেœ সংরক্ষণ করেছিলেন এসব ফুটেজ। যার ফলাফল ‘মুক্তির গান’-এর মতো অসাধারণ তথ্যচিত্র। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৯৭১ থেকে ২০১৬ স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম ৪৫ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে পরিমাণ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক বা শিল্পকর্ম হয়েছে, সে তুলনায় চলচ্চিত্রের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি সামগ্রিক বিষয় কেবল চলচ্চিত্রেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। চলচ্চিত্র শিল্পাঙ্গনের এমন একটি মাধ্যম যা তার দর্শককে আবেগ-অনুভূতি দিয়ে একাগ্র হতে সাহায্য করে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছেও তা হতে পারে এক অনন্য ইতিহাসের বিষয়। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য ইমেজ আগামী দিনের চলচ্চিত্রের প্রধান উপাত্য হিসেবে বিবেচিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মুক্তিযুদ্ধে যে ক’জন বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী আমাদের সংগ্রামের সেই উত্তাল সময়ের ছবি তুলেছেন তার মধ্যে অন্যতম কিশোর পারেখ ও রঘু রায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের রশীদ তালুকদারের অসংখ্য ছবিও স্থান পায় একাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ের পত্রিকায়। কিশোর পারেখের প্রকাশিত ‘ইধহমষধফবংয অ ইৎঁঃধষ ইরৎঃয’ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটোগ্রাফিতে মাস্টার্স করা এই আলোকচিত্র শিল্পী বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও অর্জন করেছেন। একাত্তরের আলোকচিত্র নিয়ে প্রকাশিত তার বইয়ের সব ক’টা ছবি সাদা-কালো। প্রতিটি ছবিতে এত চমৎকারভাবে তিনি অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন যা বর্ণনাতীত। বইয়ের প্রচ্ছদে কর্দমাক্ত একটি মুখে দাঁড়কাক বসে আছে। কি অসাধারণ কম্পোজিশন। কি অসাধারণ দর্শন। এসব ছবির অধিকাংশই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তোলা। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফোরগ্রাউন্ডে বুট পরে থাকা রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানী স্নাইপার খোঁজার ইমেজটি। কিশোর পারেখের ম্যাগাজিনে বর্ণনাতীত দুরবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে। রাস্তায় পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন নিথর দেহ। রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ নিখোঁজ হওয়া হাজারো মানুষকে খুঁজতে আসা স্বজনহারাদের ছবিও খুঁজে পাওয়া যায়। ম্যাগাজিনটিতে ভারতীয় জওয়ানদের বেশ কিছু ছবি রয়েছে। একটি আনন্দক্ষণ মুহূর্ত দিয়ে ম্যাগাজিনটির ইতি টানেন ভদ্রলোক। দুজন বালক সরিষাক্ষেতে ছোট্ট বাছুর নিয়ে আনন্দচিত্তে দৌড়ে যাচ্ছে। সূর্যের আলো এসে পড়েছে সরিষারক্ষেতের বাকি অংশে। এ ছবি যেন স্বাধীন দেশের কোটি মানুষের উচ্ছ্বাসের প্রতিচ্ছবি। অন্যদিকে রঘু রায়ের ক্যামেরায় উঠে আসে কোটি শরণার্থীর প্রধান ঠিকানা কলকাতার সল্টলেকের ক্যাম্পের ছবি। যুদ্ধকালীন ‘ঞযব ংঃধঃবংসধহ’ পত্রিকার প্রধান চিত্রগ্রাহক ছিলেন ভারতীয় এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। ‘ইধহমষধফবংয ঞযব চৎরপব ড়ভ ঋৎববফড়স’ নামে একটি বই তিনি প্রকাশ করেন। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু বিরল ছবি। সহায় সম্বলহীন মানুষের সীমান্ত পাড়ি দেয়ার বহু ছবি স্থান পেয়েছে এই বইয়ে। এপ্রিল মে, জুন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই এক কোটির মতো মানুষ পূর্ব বাংলা ছেড়ে ভারত পাড়ি দেয়। আতঙ্কিত মানুষের সে করুণ ছবি আজ বিমূর্ত হয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে আছে। অধিকাংশ ছবিতে দেখা যায় ক্লান্তক্লিষ্ট দেহে নিজের ভার বহন করতে অক্ষম বৃদ্ধা পাকিস্তানী হায়েনাদের আতঙ্কে দেশ ছাড়ছেন। পিপড়ার মতো লাখ লাখ মানুষের সেই বিক্ষিপ্ত মুহুর্তকে। আলো আধারের ইমেজে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা সাদা-কালো ছবিতেও জীবন্ত রূপে ধরা দিয়েছে। প্যারিসে মুক্তিযুদ্ধের এসব ছবি প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছিলেন রঘু রায়। তার এমন অসাধারণ সব আলোকচিত্রের জন্য ভারত সরকার ১৯৭২ সালে তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদশ্রী’তে ভূষিত করেন। রঘু রায় এবং কিশোর পারেখ ছাড়াও বেশ ক’জন ভারতীয় আলোকচিত্র শিল্পী একাত্তরের ছবি তুলেছেন। দেশীয় আলোকচিত্র শিল্পী রশীদ তালুকদার ও মোহাম্মদ আলমের অসংখ্য আলোকচিত্র রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ’৬৯-৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোর যেসব ঐতিহাসিক ছবির সন্ধান পাওয়া যায় তার অধিকাংশ রশীদ তালুকদার ক্যামেরায় তোলা। এসব আলোকচিত্র শিল্পীর বাইরেরও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ছবি তুলেছেন। বিশেষ করে আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ। দাপ্তরিক কাজে নিজ দেশে পাঠানোর জন্য কিছু যুদ্ধ পরিস্থিতির ছবি তুলে পাঠিয়ে ছিলেন তারা। যা দেশগুলোর গোপন নথিতে এখনও খুঁজে পাওয়া যাবে। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এই যুদ্ধে আত্মত্যাগ ও দৃঢ়তা তুলে ধরতে এসব ছবির বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সংগ্রামের কাহিনী ইতিহাসের এক বিরল অধ্যায়। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও বিশ্বকে এখনও পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চিত্র সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। একটি রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে জাতির জন্ম তারা যদি সঠিকভাবে নিজেদের ইতিহাস তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়, তবে এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কি আছে! এ কারণে আমাদের মনোবল, দৃঢ়তা ও সাহসিকতা উপলব্ধি করতে বিদেশীরা ব্যর্থ হয়। একাত্তরের সঠিক মূল্যায়ন আজও হয়নি। প্রতিফলিত হয়নি আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে কার্যকরভাবে উপস্থাপন না করাই এর মূল কারণ। ১৯৭১ সালে দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশারফকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছিল। দুঃসাহসিক ব্রিটিশ টিভি সাংবাদিক ভানিয়া কেউলি তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করেছিলন। ‘কে ফোর্সের’ কমান্ডার খালেদ মোশারফের যুদ্ধদিনের দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে তৈরি এই ডকুমেন্টারি। তথ্যচিত্রে দেখা যায় খালেদ মোশারফ অসাধারণ দৃঢ়তা ‘পাকিস্তানীদের আসতে দাও, তারা হেরে যাবে।’ তিনি পাকিস্তানীদের অগ্রসরতা নিয়ে মোটেও বিচলিত ছিলেন না। পাকিস্তানীরা বিশ্বকে বলেছিল এটা বিচ্ছিন্নবাদীদের সীমান্ত যুদ্ধ। কিন্তু তথ্যচিত্রে দেখা যায় দেশের একদম গভীরেই ‘কে ফোর্সে’র নিয়মিত বাহিনী জীবন বাজি রেখে যুুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। জুন মাসে ‘মেজর খালেদ ওয়ার’ তথ্যচিত্রটি নির্মাণের জন্য কেউলি আটদিন রণাঙ্গনে সময় কাটিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমান সময়েও নতুন করে তথ্যচিত্র নির্মাণ করা সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিংবা ঐতিহাসিক অনেক যুদ্ধই বর্তমানে নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে আমাদের রুচির ও আবেগের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইতিহাসকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন তাই অত্যন্ত জরুরী। আমরা একাত্তর নিয়ে রাজপথে গলা ফাটাই! কিন্তু তা সংরক্ষণে কিংবা নতুন প্রজন্মমকে উপস্থাপনের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করি না। মুক্তিযুদ্ধের সকল ইমেজ কিংবা আলোকচিত্র সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ যেমন জরুরী, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো এসব ইমেজ অবলম্বনে রঙিন তথ্যচিত্র নির্মাণের। আগামী প্রজন্মকে সকল সৃজনশীল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করাই হবে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।
×