ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় : দ্বিতীয় খণ্ড পঞ্চম অধ্যায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের সাংবিধানিক একনায়কত্ব এবং আমার আমেরিকায় প্রথম ভ্রমণ (গতকালের পর) এমনকি শিক্ষকরাও তাতে ইন্ধন যোগালেন। এই বছর তাই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করল। এই রিপোর্টটি বাতিলের দাবিতে ঢাকায় ছাত্রমহল ১৭ সেপ্টেম্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেই বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে আইন প্রয়োগকারী পুলিশ দু’জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। গোলাম ফারুকের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানে কোন শান্তি ছিল না এবং সর্বত্রই বিশৃঙ্খলা প্রাধান্য লাভ করে। অন্যদিকে গোলাম ফারুকের ছেলে বাংলাদেশের ব্যবসা ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের শক্তিশালী উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসী বাঙালী কর্মকর্তাদের সাবধানতার ফলে তিনি সাফল্যের মুখ দেখলেন না। অবশ্য, তাতে কিছু কর্মকর্তার নানা অসুবিধায় পড়তে হয়। বিশেষ করে তদানীন্তন সরবরাহ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। আমার সবিশেষ মনে আছে, এই পরিদফতরের শীর্ষ ব্যক্তি এ কে এম আজিজুল হককে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয়। তবে আইনের বিধান ও বিধিমালা তাকে রক্ষা করে। এই লাট সাহেব একটি অত্যন্ত ক্ষতিকারক সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্মাণাধীন ৭ তলা সচিবালয়ের কাজ বন্ধ করে দেন। সেখানে সরকারী বাস্তুকলাবিদ একজন ডাচ কর্মচারী অতি জোরালোভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলেও তাতে এই ব্যক্তির সিদ্ধান্ত অটল থাকল। ডাচ কর্মচারী জানাল যে, স্থাপনাটির নীলনকশা আধুনিক প্রযুক্তি অনুযায়ী করা হয়েছে এবং এটি খুবই ব্যয়সাশ্রয়ী হবে। সেন্ট্রাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ স্বল্প খরচে চলবে। সেই বিবেচনায় প্রত্যেক তলায় ছোট ছোট কামরা এবং নিচু উচ্চতার দালানের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিনি আরও বললেন, এই স্থাপনায় ইলেকট্রিক পাখা দিতে হলে স্ট্যান্ড পাখা দিতে হবে এবং অনেক জানালা দিতে হবে যা দৃষ্টিনন্দন হবে না এবং ডিজাইনকে একেবারেই বিনষ্ট করে দেবে। কিন্তু স্বৈরাচারী লাট সাহেব কোন যুক্তিই শুনলেন না। এই দুষ্টু সিদ্ধান্ত তার পরবর্তী লাট সাহেব বছর চারেক পরে নাকচ করলেন। তবে ততদিনে সেন্ট্রাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের প্লান্টটি নষ্ট হয়ে সরকারের অনেক ক্ষতি করে ফেলে এবং অতিরিক্ত জানালা নির্মাণে অযথা অনেক খরচ হয়ে গেছে। যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই ২৮ অক্টোবর গোলাম ফারুক পদত্যাগ করে দেশটিকে রেহাই দিলেন। গোলাম ফারুকের উত্তরসূরি হলেন ময়মনসিংহের উকিল এবং পরোক্ষভাবে নির্বাচিত জাতীয় পার্লামেন্টের সদস্য আবদুল মোনেম খান। তিনি মোটামুটিভাবে একজন জেলা পর্যায়ের মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন এবং এক সময় ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৬২ সালের ১২ অক্টোবর তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। পরবর্তী সাত বছর তিনি এই পদে বহাল থাকেন এবং রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিশ্বস্ত সহকারী হিসেবে তার খেয়াল খুশি ও নির্দেশনা অত্যন্ত নিপুণভাবে পালন করেন। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব ১৯৬৯ সালে যখন তার গোলটেবিল বৈঠক শুরু করলেন তার অব্যবহিত পূর্বে মার্চে মোনেম খানকে অব্যাহতি প্রদান করলেন। ঢাকায় সেই সময় একজন করিৎকর্মা আইসিএস কর্মকর্তা (১৯৩৭) গোলাম আহমদ মাদানী ছিলেন ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি প্রায় বছর দেড়েক আগে পল্টন ময়দানের সন্নিকটে একটি জামে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এই মসজিদটি বায়তুল মোকাররমের আদলে নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদের ’৬২ সালের সমাপ্তিলগ্নে ২৬ ডিসেম্বর নামাজ আদায় শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রথমদিকের গবর্নর জেনারেল এবং পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন অকস্মাৎ রাজনীতিতে ফিরে এলেন এবং তারই উদ্যোগে নবেম্বর মাসে মুসলিম লীগের একটি কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। এর কোন প্রভাব পূর্ব পাকিস্তান রাজনীতিতে মোটেই ছিল না। কিন্তু ইতোমধ্যে নানা উপদলে বিভক্ত পাকিস্তান মুসলিম লীগে তাতে কিছু পরিবর্তনের সূচনা হয়। শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো, সেইটিই ক্রমে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে পরিণত হলো। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে চলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন যে, আইয়ুবের একনায়কত্ব অবসানের জন্য জাতিকে কাজ করতে হবে এবং সে জন্য আইয়ুবের আইনের অধীনে কোন রাজনৈতিক দল গঠন উচিত হবে না এবং আওয়ামী লীগ সেই নীতিই প্রতিপালন করে চলল। অস্থিতিশীল অবস্থায় দেশের রাজনীতি থাকল উত্তপ্ত। ৯ সেপ্টেম্বরে সংবাদপত্র ধর্মঘট ছিল একটি অসাধারণ ঘটনা। বছরের শেষ দিকে জনাব সোহ্রাওয়ার্দী ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে ইন্তেকাল করেন। আমি শুনেছি যে, ঢাকায় তার জানাজায় ছিল সেকালের বৃহত্তম জনসমাবেশ। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আমি তখন বাংলাদেশ সচিবালয়ের নতুন যোগাযোগ বিভাগের উপসচিব। এই বিভাগের নামটি ছিল অত্যন্ত লম্বা- রেলওয়ে, নৌযান ও রোড ট্রান্সপোর্ট বিভাগ। নতুন বিভাগে আমাদের প্রধান কাজটি হলো মার্কিন আর্মি কোর অব ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশের ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের ওপর যে একটি প্রতিবেদন প্রদান করে সেটির মূল্যায়ন এবং বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ। এই প্রতিবেদনটি বিবেচনা করতে গিয়ে আমার অর্থনীতির প্রতি আকর্ষণ অনেক বেড়ে গেল। বলে রাখা ভাল যে, ১৯৬২ সালে আমি যখন গবর্নরের ডেপুটি সেক্রেটারির পদ ছাড়ি তখন আমাকে তিন মাসের জন্য একটি এ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট কোর্সে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে (নিপা) পাঠানো হয়। আমার এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অত্যন্ত উৎসাহ এবং আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করি। সেখানেই আমি বাংলাদেশের ডেপুটি কমিশনারের কাজকর্ম নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রণয়ন করি। এই সমীক্ষা পরবর্তীকালে (৬ বছর পরে) ১৯৬৮ সালে আমার প্রথম গ্রন্থ ডেপুটি কমিশনার ইন ইস্ট পাকিস্তান নামে প্রকাশিত হয়। এই প্রশিক্ষণ কোর্সই অর্থনীতি সম্বন্ধে অধিকতর পড়াশোনা করতে আমাকে আগ্রহান্বিত করে তোলে। তার সঙ্গে যোগাযোগ সমীক্ষাটি মূল্যায়নের দায়িত্ব পড়ায় আমি তখন মোটামুটিভাবে আবার একজন অর্থনীতির ছাত্র হয়ে গেলাম। অর্থনীতি এবং পরিকল্পনা সম্বন্ধে এই যে আমার আগ্রহের সূচনা হলো সেই আগ্রহটি নিরবচ্ছিন্নভাবে পরবর্তী জীবনে কার্যকরী হয়। সম্ভবত এই আগ্রহের কারণেই তখন প্রাদেশিক পরিকল্পনা বিভাগে যেসব মার্কিন কর্মকর্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এই ঘনিষ্ঠতাই আমাকে পরবর্তী বছরে উচ্চ শিক্ষার জন্য হার্ভার্ডে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। ১৯৬২ সালে প্রথম পর্বে আমি লাট সাহেব লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম আজম খানের সঙ্গে ব্যস্ত দিন কাটাই। তারপর ৩ মাসের জন্য একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করি। আমি আগেই বলেছি যে, আমার পদায়ন নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল। তার সমাধান হলো পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারে একটি নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এই বিভাগটির কিছু কাজ আগে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সাধিত হতো। এই বিভাগের প্রথম দিকে নামটি ছিল খুব লম্বা, যথা- রেলওয়ে, পানিপথ এবং সড়ক যোগাযোগ (জধরষধিুং, ডধঃবৎ ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃ, জড়ধফ ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃ উবঢ়ধৎঃসবহঃ)। সেই মন্ত্রণালয়ে ছিলেন একজন সচিব, ২ জন উপসচিব এবং ১ জন উপসচিব মর্যাদার আর্থিক উপদেষ্টা। এই মন্ত্রণালয়ে দুজন সচিবের অধীনে আমি কাজ করি। তারা ছিলেন ১৯৪৮ সালের সিএসপি উত্তর প্রদেশের অধিবাসী নুসরত হাসান এবং একজন পুরনো কৃতী প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা আবদুর রশিদ। তিনি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন বিভাগ পূর্বকালে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে নিযুক্ত করা হয় তাদের মধ্যে ৫ জন বাঙালী কর্মচারীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। চলবে...
×