ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

রোহিঙ্গা সমস্যা ॥ এক যাত্রায় পৃথক ফল নয়, চাই মানবিক সমাধান

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৬

রোহিঙ্গা সমস্যা ॥ এক যাত্রায় পৃথক ফল নয়, চাই মানবিক সমাধান

এক যাত্রায় পৃথক ফল বলে একটা কথা চালু আছে। এর মানে বোঝা কঠিন কিছু নয়। আমাদের অনেক আচরণ বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই তার উৎকৃষ্ট নজির বহন করে। আজ আমরা মিয়ানমারে যে তা-ব দেখছি তা সভ্যতাবিরোধী। এমন দানবীয় আচরণ মিয়ানমার কেন, যে কোন দেশ বা জাতির জন্য লজ্জাকর। এরা অনেক আগেই সে লজ্জার মাথা খাওয়া জাতি। খুব বেশি দিনের কথা নয়, যখন এই দেশের সামরিক জান্তার নির্দেশে গণতন্ত্রের জন্য রাস্তায় নেমে আসা জাফরান রংধারী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ওপর চলেছিল দানবীয় আক্রমণ। এখনও সে ছবি আমার মানসপটে সচল। অসহায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রক্তে রঞ্জিত সেইসব ছবি ও অনাচারের ওপর জনকণ্ঠে একটি লেখাও লিখেছিলাম। অনাচারের নিয়ম এই, যখন সে প্রতিরোধহীন বা কেউ তাকে থামাতে এগিয়ে আসে না, তখন বাড়তে বাড়তে এক সময় জন্তুর রূপ নেয়। বিশ্ব মুরব্বিরা অজানা কারণে বা স্বার্থের কারণে মিয়ানমারের ব্যাপারে সব সময় বরফ শীতল। রাজনীতি কি বলে জানি না। তবে নিন্দুকেরা বলে বার্মা তথা মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা নাকি নিয়মিত কর দিত। ভাববেন না এই কর নগদ। এখন দিন পাল্টেছে। কর বা নজরানার স্বরূপ গেছে বদলে। তাদের দেশের সম্পদের ওপর বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ আর সোনা-দানার বাণিজ্য হাতে থাকলেই হলো। কে যাবে ন্যায্যতা বা বিচার নিশ্চিত করতে? যার যা প্রাপ্য তা বুঝে পেলে মানবতার নিশান ওড়ানো দেশগুলো তখন আর টুঁ শব্দটিও করে না। মিয়ানমারের জান্তার মেয়ের বিয়েতে দেয়া সোনার পরিমাণ সোনার টয়লেট ভাইরাল আকারে সামাজিক মিডিয়ায় এসেছিল। কয়েকদিন হৈচৈয়ের পর সবাই ভুলে গেছে। অথচ এর চেয়ে অনেক কম সম্পদ আর লুটপাটের কারণে কোন কোন দেশের শাসককে সে দেশ থেকে হেলিকপ্টারে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও দেখেছি আমরা। মধ্যপ্রাচ্যের কথা ভাবুন। সাদ্দাম হোসেনের আমলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করত। স্কুলে যেত। বাজার করত। একনায়ক হোক আর যাই হোক মানুষ তাদের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারত। এখন? গণতন্ত্রের নামে প্রতিদিন খুন, মারামারি, বোমা আর সবকিছু অচল হয়ে যাওয়া এককালের সভ্যতার এই পীঠভূমি। দেশটিতে চলছে দানবীয় ট্যাঙ্ক আর বিদেশী বনাম স্বদেশীর লড়াই। মিয়ানমারের কপালে এমন কিছু ঘটার কথা থাকলেও ঘটেনি। তাদের দেশের শাসকরা লৌহ কঠিন। রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন বা নিপীড়ন এর পেছনে অনেক কারণ। এরা বাংলাদেশের লাগোয়া সীমান্তের অধিবাসী। নব্বই দশকের গোড়ায় আমি সেখানে কাজ করতাম। কক্সবাজারে থাকলেও মাঝে মাঝে টেকনাফ যেতে হতো। নাফ নদী পার হলেই মু-া। বাংলাদেশের মানুষ আকছার পার হতো, তারাও আসত এদিকে। এরকমের একজনকে পেয়েছিলাম, রাস্তায় বসে বাসনপত্র, ছাতা, চটিজুতা বিক্রি করছে। চট্টগ্রামের ভাষার খুব কাছাকাছি; কিন্তু হুবহু নয় এমন এক ভাষা তাদের। তবে আমরা যারা চাটগাঁর লোক আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে লোকটিকে বলতে শুনি তার রাজা নাকি এরশাদ। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলামÑ কিভাবে? তার উত্তর ছিল, থাকি বটে ওরা আমাদের মারে। আমাদের পছন্দ করে না। আমরা এদিকে এসে ব্যবসা করে খাই, তাই আমাদের রাজা এরশাদ। আবেগের দিক থেকে শুনতে ভাল বটে; কিন্তু এটা কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশের কোন হিন্দু বা সাঁওতাল যদি একই কারণে বেনাপোল বর্ডারের ওপার গিয়ে বলে আমার রানী মমতা দিদি, সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে? আমাদের সরকার বা রাজনীতি নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত তারা এসবের খবর রাখত না। শুধু তা নয়, এরপর দলে দলে রোহিঙ্গার আগমন ওই এলাকার দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে একেবারে। মানবিক দৃষ্টিকোণে কাউকে আশ্রয় দেয়া বা পরে ফেরত পাঠানোর একটা তরিকা আছে। সেটার নাম কূটনীতি। সেসব কিছুই কাজ করেনি। অনুপ্রবেশের ভেতর দিয়ে আসা নিরীহ শরণার্থী রোহিঙ্গাদের জঙ্গী হয়ে ওঠাও ঠেকাতে পারিনি আমরা। অত্যাচারিত বা মার খেয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালানো মানুষ কখনও তার অতীত ভুলতে পারে না। সে দেশে যায়, সঙ্গে করে তার ভেতরে সেই ক্রোধও নিয়ে যায়। পশ্চিম বাংলার বাংলাদেশী হিন্দুরা যে কারণে কংগ্রেস বা বাম দলের চাইতে বিজেপিকে সমর্থন করে বেশি। মোহাজেররা লন্ডনে বসেও পাকিস্তান বিরোধিতায় মশগুল। তামিলরা এখনও সুযোগের আশায় দিন গোনে। বাংলাদেশে অপরিকল্পিতভাবে আগত রোহিঙ্গারা তাই তাদের মনের আগুনকে কাজে লাগিয়েছে অন্যভাবে। রামুর কথা মনে আছে? বুদ্ধের ওপর, বৌদ্ধদের ওপর এমন হামলা আগে কখনও হয়নি। পরে জানা গেল এর পেছনে বা এই কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হয়েছিল। যে কারণে নৃশংসতার দিকটা ছিল ভয়াবহ। রোহিঙ্গারা আমাদের মাটির সন্তান না। এদের সঙ্গে আমাদের ভাষা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বা জীবন কোনটাই মেলে না। আমাদের দেশের হাজার হাজার বছরের পরম্পরা সমতা কিংবা পারস্পরিক বোঝাপড়া বিষয়ে এদের কোন ধারণাই নেই। পাঞ্জাবীরা যেমন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় জোশে হিতাহিত চিন্তা ভুলে যেত, মাড়োয়ারিরা যেমন শোষণের সময় একবিন্দু ভাবে না এরাও ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দে কিছু ভাববে না। এটাই স্বাভাবিক। কেবল ধর্মীয় বিবেচনায় যদি মানুষ মানুষের বন্ধু বা প্রতিবেশী হতো আরব দেশগুলো কবেই ইসরাইলকে কাত করে, চিত করে দিতে পারত। সেটা না হওয়ার কারণ কি খালি আমেরিকা? এতকিছুর পরও ইসরাইলী আর ফিলিস্তিনীরা যতটা কাছের মিসরীয় আর আমিরাতের লোকেরা ততটা দূরের। আমরা এসব না মানলে মানবিক দিকটা যেমন মানা হবে না, তেমনি রোহিঙ্গাদের উপকারেও আসতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারটা যারা বলেন তারা আংশিক সত্য বলেন। ভারত সরকার জানত এই লড়াইয়ের একটা না একটা ফলাফল আসবেই। সেটা যেদিক থেকেই হোক ভারতের লাভ ব্যতীত লোকসান কিছু নেই। ভারত তার চিরদুশমন পাকিস্তানকে সাইজ করার কথাটাও মাথায় রেখে কাজ করেছিল। তাছাড়া আমাদের যুদ্ধ ছিল স্বাধীনতার লড়াই। সারা দুনিয়ায় এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও সমর্থনও ছিল প্রবল। রোহিঙ্গারা এসবের ধারে-কাছে নেই। তাদের ঘটনাটা সে দেশের নেহাত নিজস্ব। আমরা অবশ্যই গণহত্যার বিরুদ্ধে। যে জাতি নিজে গণহত্যা আর দেশান্তরী হওয়ার শিকার সে কখনও তার সমর্থক হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ তা চায়ও না। আমাদের দেশের মানুষ সব সময় উগ্রতাবিরোধী। তাদের জীবনে শান্তির বিকল্প নেই। কিন্তু তারপরও চাইলেই যে পাওয়া যায় তা তো নয়। আমাদের নিজেদের সমস্যার অন্ত নেই। মাত্র কিছুদিন আগে নাসিরনগরে ঘটে গেছে মারাত্মক ঘটনা। সংখ্যালঘু নামে পরিচিত হিন্দুদের জীবন সেখানে তোপের মুখে। একশ্রেণীর উন্মাদ মানুষ এখন ধর্মের নামে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগানোর ফায়দা নিতে ব্যস্ত। সাঁওতালদের নিয়েও বিপদে আছে দেশ। আছে গুলশান ঘটনার মতো অপরাধপ্রবণতা। তাই মানবিকতার দুয়ার খোলা ছাড়া কোন পথ খোলা নেই আমাদের। বিশ্ব বিবেকের দরজায় কড়া নাড়তে হবে রোহিঙ্গাদেরই। তাদের মুখপাত্র বা মানুষজনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলা। আমরা সমর্থন দেব। পাশে দাঁড়াব। দরকারে যারা একেবারে অসহায় মরণাপন্ন তাদের আশ্রয় দেব। কিন্তু সামাজিক মিডিয়ায় অকারণে যুদ্ধ লড়াই বা মারামারি চাওয়াদের মতো হঠকারী কিছু করতে পারে না বাংলাদেশ। বলছিলাম এক যাত্রায় পৃথক ফলের কথা। শান্তিতে নোবেল পেয়ে অং সান সুচি যখন মুখ বন্ধ রেখে অপরাধ করেন আমরা গর্জে উঠি। আমাদের শান্তির নোবেলজয়ী কেন নীরব? তার কি বলার কিছু নেই? দেশের ব্যাপারে তিনি নানা ধরনের অভিযোগ তোলেন সেটা না হয় মেনে নিলাম। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কেন মুখ খোলেন না? একজন মানুষ যখন নোবেলের মতো বিশ্বসেরা পদক পান এবং তা শান্তিতে তখন কি তিনি আন্তর্জাতিক মানুষে পরিণত হন না? সে জায়গাটা থেকেও তো বলা যেতে পারে। এই নীরবতা দুনিয়াকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। চলুন নিজেদের জায়গা বিবেচনা করে তারপর আওয়াজ তুলি। বাঁচাই সেসব মানুষকে যাদের সঙ্গে আসলে কেউ নেই। এর নামই মানবতা।
×