ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

রং ও রেখার রূপকার

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

রং ও রেখার রূপকার

বিংশ শতকে লোকজ শৈলী এবং আধুনিক চিত্র প্রকৃতির এক অত্যাশ্চর্য সুষ্ঠু সমন্বয়ে শিল্পে নতুন অবয়ব দানে সার্থক শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। চিত্রকর ছাপচিত্রী বা প্রচ্ছদ ডিজাইনার সকল ক্ষেত্রেই তার সিদ্ধ বুনন লক্ষণীয়। শিল্পপটে কাব্যিক সুরের অটুট গাঁথুনি গেঁথেছেন প্রতিটি পঙ্ক্তির একক বর্ণমালায়। প্রকৃতিকে আপাত দৃষ্টির হুবহু উপস্থাপন থেকে মুক্ত করার প্রয়াস নিয়েই নিসর্গে আলো ছায়ার স্বভাবসুলভ দোলাচল বর্জিত নক্সার শুদ্ধতায় রূপায়িত করেছেন তার শিল্প কর্মে। আবার নক্সার নিয়মকেও ভেঙ্গে প্রাণবন্ত চিত্রময়তায় ফুটিয়েছেন বহু কৌণিক দৃষ্টির আকৃতির বিন্যাসে। লোককলার গভীরে শেকড় সন্ধানের নিমিত্তে অবিচল অন্বেষণরত ছিলেন এই খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী। গ্রামবাংলার পলিমাটির সুগন্ধ আস্বাদনে উদ্ভূত করে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিটি সৃষ্টি। লোকজ অনুপ্রেরণার স্বকীয় ধারা সংমিশ্রণে আবিষ্ট করে গ্রামীণ জীবন ও আবহ ফুটিয়ে তুলেছেন এই স্বনামধন্য শিল্পী। সহজ সাবলীল লালিত্যময় বিষয় উপস্থাপনে তার দক্ষতার পরিচয় মেলে। রুক্ষতাবর্জিত জ্যামিতিক অলঙ্করণের আভা, ছন্দিত রেখায় সজ্জিত শিল্পীর শিল্প জমিন। লাল, সবুজ, নীল, হলুদ, মেটুলি রংকে পরিচিতি দান করেছে সাদার উজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্য দ্যয়ে। চিত্রকে উল্লম্ব ও আনুভূমিক রেখার খাঁচাবদ্ধ কম্পোজিশন থেকে ছুটি দিয়ে তির্যকভাবে ডানে বা বাঁয়ে একটু হেলিয়ে উপস্থাপন করেছেন। জল প্রবাহের ধারার গতিতে প্রকাশিত শিল্পীর গ্রামটিকে চিনতে ভুল হয় না কখনই। ঘনসবুজ, পত্রপল্লব, শূন্যতায় দোদুল্যমান লতিকার লুকোচুরি, পাতার ফাঁকে রোদের উঁকি দেয়া এ সবই তার রং-রেখায় প্রাণ পেয়েছে। বাংলার বধূর হাতে সৃষ্ট নকশীকাঁথার ফোঁড় হাত পাখার রৈখিক অলঙ্করণ দিয়েই বুনেছেন। আলো কমিয়ে বাড়িয়ে রঙের কারুকার্যতায় নানা পর্দা তৈরি করেছেন শিল্পে। তাঁর চিত্রে ফুলেল অনুসঙ্গে উজ্জ্বল রঙের প্রলেপণে মনে হয় লাল, নীল, হলুদ ফুল যেন ফোটেনি, বরং কিছু বর্ণচ্ছটা ধরেছে গাছে। ধানের ক্ষেত, হলুদ সরষে ফুল, নারীর লালপেড়ে নীল শাড়ি প্রভৃতির সরল উপস্থাপন ঘটেছে তার কাজে। আকাশ, মেঘমালা, পাখি, মানুষ, গাছপালা, লতাপাতায় এক চিরচেনা গল্প রচনা করেন এই রূপকার। কাইয়ুম চৌধুরীর কাজে চড়া রঙের উপস্থাপনের পেছনে তার কাঙরা ও বাসুলী চিত্রের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। পাশাপাশি ইম্প্রেশনিজম ধারাও যে তাকে কিছুটা আকৃষ্ট করেছিল তাও ফুটে উঠেছে শিল্প রচনায়। তার চিত্রের গ্রামের উঁচু গাছের ডালে বসে থাকা পাখির কলকাকলির মনোমুগ্ধকর সুর শীতল করে দেয় দর্শকের শ্রবণেন্দ্রীয়। গীতিকাব্যের সুর ছিল তার চিত্রের অন্যতম গুণ। নৌকার গলুই, চোখ ও বৈঠার কাঠামোতে নক্সার উচ্ছ্বাস সর্বদাই কাব্য ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উন্মাদনাকেও সাজিয়েছেন দক্ষ পরিমার্জিত তুলির ছোঁয়ায়। উত্তোলিত পতাকা, মাথায়, গামছা বাঁধা যোদ্ধার উর্ধ পানে উত্থিত হাত, উচ্ছ্বসিত ও সংগ্রামী আওয়াজ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে প্রতিবিম্বরূপ দান করেছে। তার চিত্র রচনায় নানামুখিতার প্রতিফলন পাই তেল রং, জল রং, কালি কলম, এ্যাক্রিলিক ও ছাপচিত্রসহ ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমের কাজে। অভিন্ন মোটিভে রং ও রেখার সঞ্চালনে প্রথম প্রকাশক শিল্পী না হলেও তিনি ছিলেন প্রধান ও মৌলিক। তার চিত্রের বিষয়বস্তুতে সাধারণ জনজীবন বন্যা প্রকৃতির রূপময়তা নৌকাÑ এগুলোই এসেছে ঘুরে ফিরে যদিও তাতে একঘেয়েমির ছিটেফোঁটা আসেনি এক মুহূর্তের জন্যও। কাঠের পুতুলের পুরো এ্যানাটমি ভেঙ্গেও শিল্প সৃষ্টি করেছেন তিনি। যা কিউবিজম অনুপ্রেরণার নিঃসন্দেহে প্রমাণ বহন করে। যামিনী রায় কালিঘাটের পট হুবহু অনুকরণ করেছেন তবে কাইয়ুম চৌধুরী তাকে আধুনিকতার মোড়কে পুরে উপস্থাপন করেছেন। আর এখানেই তার কৃতিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলার বিলুপ্তপ্রায় লোক শিল্পকেই তিনি তার শিল্প রচনার একমাত্র হাতিয়ার করেছিলেন। তার নিভৃত শিল্প সাধনায় ভিড় জমতে থাকা লোকায়ত শিল্পরূপকে ছেঁকে নক্সার ছাঁচে রূপদান করেছেন। কুয়াশার আচ্ছন্ন নৌকা, মেরামতরত ভাঙ্গা নৌকা, ভরাপালে ভেসে চলা নৌকা শাপলা ফুটে থাকা জলে নৌকার নানামুখী উপস্থাপন দেখতে পাওয়া যায় এমন আরও কত চিত্র। বিলে কচুরিপানা ফুলসহ, বক, মাছ, কাক নর-নারীসহ নৌকার উপস্থাপন ঘটিয়েছেন তার অসংখ্য শিল্পকর্মে। সূর্য নিছক বৃত্ত করেই সাজিয়েছেন তার চিত্রে। তবে সেই সূর্যকে জীবনের শক্তিময়তা এবং পূর্বের আড়ম্বর বর্জিত বিশুদ্ধতার নক্সায় প্রকাশ করেছেন। লোকায়িত চিত্রতেই খুুঁজে পেয়েছেন জীবন সংগ্রামে নিমজ্জিত গহীন উপলব্ধি। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির সজীবতা নদীর শান্ত শীতল মন্থরতা, নারীর কোমল আবেগ, আত্মপ্রতিকৃতিও এঁকেছেন। অচিন পাখির উপস্থাপন দেখা যায় তার শেষের দিকের কাজে। ফবিস্ট শিল্পী মাতিসকো স্মরণ করিয়ে দেয় রং সংবরণের জাঁকজমকতাপূর্ণ কাইয়ুম চৌধুরীর কাজগুলো। ধূসর আচ্ছাদনের চিত্রকর্মগুলো সময়ের গতিময়তার হাত ধরে চলতি পথের বাঁকে বর্ণ উজ্জ্বল রঙিন পদচারণা করে ক্রমেই মৃদু কোমল রূপময়তার বিবর্তিত রূপে পরিণত হয়েছে। রংকে পোষ মানাতেই শিল্পী কখনও ছেড়ে দিয়েছেন সাদা জমিন কখনও বা ব্যবহার করেছেন কালো। রংকে স্বয়ম্ভূ করেই লোকজ কর্মের খ- রেখার সন্নিবেশে উপস্থাপন করেছেন তার বিষয়বস্তুগুলোকে। পল্লীবালা, জেলের জীবন অর্থাৎ নদীমাতৃক গ্রামীণ সরল নির্মলতার সঙ্গে সঙ্গেই সংগ্রামী উল্লাসরত বীরত্ব ব্যঞ্জক মুক্তিযোদ্ধার শ্রমজীবী করা কঠিন কৃষককেও পূর্ণতা দান করেছেন। আপন হাতের ঐন্দ্রোজালিক কারুকার্যময়তায়। শিল্পকে করেছেন সদা সজীবতামুখর নান্দনিক রূপ- রসের মিলনমেলা।
×