ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ঐতিহ্যবাহী ঘোড়দৌড়

কদম দৌড়, দাপট দৌড়- দেখতে মানুষের ঢল

রফিকুল ইসলাম রনি

প্রকাশিত: ২৩:২৫, ৪ মে ২০২৪

কদম দৌড়, দাপট দৌড়- দেখতে মানুষের ঢল

পাবনার চাটমোহরে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় কয়েকজন প্রতিযোগী

বেশ উৎফুল্ল দেখা গেল ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে আসা সিরাজগঞ্জের তাড়াশ হামকুড়িয়া গ্রামের শাজাহান আলী ও উল্লাপাড়া উপজেলার শফিকুল ইসলামকে। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তারা জানান, এই খেলা আমাদের গ্রামবাংলার গর্ব। লোকজ সংস্কৃতির অংশ। ঘোড়া যখন দৌড় দেয় মনটাও তখন ছুটে যায়। শাজাহান আলী, শফিকুলের মতো উচ্ছ্বসিত দূর-দূরান্ত থেকে ঘোড়দৌড় দেখতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ।

আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময় এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সম্প্রতি পাবনার চাটমোহর উপজেলার ধানকুনিয়া দক্ষিণপাড়া বাজার পার্শ্ববর্তী মাঠে দুদিনব্যাপী এ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। 
প্রতিযোগিতা দেখতে ঢল নামে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের। সাজানো হয় প্রতিযোগী ঘোড়া, খেলার মাঠ ও আশপাশের এলাকা। প্রতিবছর বৈশাখ উপলক্ষে চাটমোহর ডিএনএফ মানবকল্যাণ ফাউন্ডেশন এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। 
নড়াইল, টাঙ্গাইল, বগুড়া, পাবনা, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ৫০টি ঘোড়া নিয়ে প্রতিযোগীরা এতে অংশ নেন। প্রথমদিন অংশ নেওয়া ঘোড়াগুলোকে ছোট, মাঝারি ও বড় তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

বাছাইকৃত ঘোড়া পরের দিন চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। কদম দৌড়, দাপট দৌড় ও শেষ পর্বে বিজয়ী তিনটি ঘোড়া নিয়ে চ্যাম্পিয়ন দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বিজয়ীদের আকর্ষণীয় পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্রতিযোগিতায় চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, তাড়াশ ও উল্লাপাড়ার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ হাজার হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লোক উপস্থিত হয়ে এই প্রতিযোগিতা 
উপভোগ করেন।
শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের অনেক দেশেই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ ভারত, পাকিস্তান, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, গ্রিস, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, হংকং এবং দক্ষিণ কোরিয়া।  ঘোড়দৌড় খেলাকে ঘিরে অনেক দেশ তাদের বিশেষ ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। 
ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের ঘোড়দৌড় খেলা রয়েছে। যেমনÑ ফ্ল্যাট রেসিং, এ খেলায় ঘোড়াগুলো সোজা বা ডিম্বাকৃতির ট্র্যাকের চারপাশে দুটি পয়েন্টের মধ্যে সরাসরি দৌড়ে যায়। জাম্প রেসিং- এ খেলা স্টিপলচেসিং নামেও পরিচিত, যেখানে ঘোড়াকে বাধা অতিক্রম করে দৌড়াতে হয়। হারনেস রেসিং খেলায় ঘোড়াগুলো দ্রুতগতিতে চালককে টেনে নিয়ে যায়। স্যাডল ট্রটিং- এ ঘোড়াকে স্যাডলের নিচে একটি প্রারম্ভিক বিন্দু থেকে শেষ বিন্দুতে ট্রট করতে হয়। সহনশীলতা দৌড়- এ খেলায় ঘোড়াগুলো অনেক দূরত্বে ভ্রমণ করে। সাধারণত ২৫ থেকে ১০০ মাইল পর্যন্ত। 
ঘোড়দৌড়ের মধ্যে রথের দৌড় ছিল প্রাচীন গ্রিস, রোম এবং বাইজেন্টাইন সা¤্রাজ্যের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। ৬৪৮ খ্রিস্ট পূর্বে রথ এবং মাউন্ট করা ঘোড়দৌড় উভয় ইভেন্টই ছিল প্রাচীন গ্রিক অলিম্পিকের অংশ এবং অন্যান্য প্যানহেলেনিক গেমস্ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। রথ দৌড়চালক এবং ঘোড়া উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। প্রায়ই গুরুতর আঘাত এবং এমনকি মৃত্যুর দিকেও ধাবিত করে এটি। 
বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেককিছুই আজ বিলুপ্তির পথে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। 
ঐতিহ্যটিকে টিকিয়ে রাখতে দেশের কোথাও কোথাও এখনো ঘোড়দৌড়ের বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়ে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন এবং গ্রামীণ জনপদের প্রভাবশালী সংগঠকরা এ খেলার আয়োজন করে প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

×