ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরওয়ার হক চৌধুরী

বৈচিত্র্যময় প্রজাপতি

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

বৈচিত্র্যময় প্রজাপতি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ‘উড়লে আকাশে প্রজাপ্রতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে প্রজাপতি মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও আয়োজনের ব্যতিক্রম ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ ঢাকা থেকেও অনেকে এই প্রজাপতি মেলা দেখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুটে গেছেন। পৃথিবীতে বনাঞ্চল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রজাপতি এবং মৌমাছির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই প্রজাপতির অস্তিত্ব বিনষ্ট হলে বনাঞ্চলের অস্তিত্বও বিনষ্ট হতে পারে। তাই পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে প্রজাপতির অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বেশ কিছু রাষ্ট্র প্রজাপতি রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। তেমনি একটি রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। তাই সিঙ্গাপুরের সান্তোজা আইল্যান্ডে বিখ্যাত বাটার ফ্লাই পার্ক দেখার অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তুলে ধরতে চাই। সিঙ্গাপুরের সান্তোজা আইল্যান্ডে বিখ্যাত বাটার ফ্লাই পার্ক রয়েছে। সেটিই দেখতে সান্তোজা আইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হলাম। প্রথমে ট্যাক্সিক্যাবে পরে ক্যাবল কারে চেপে সান্তোজা আইল্যান্ডে পৌঁছে যাই। সান্তোজা আইল্যান্ডে পৌঁছতেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। সহনীয় গরমের মাঝে সুশীতল বাতাসে সান্তোজা আইল্যান্ডের পরিবেশ মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। সান্তোজা আইল্যান্ড এলাকায় কখনও শাটল বাস আবার কখনও শাটল ট্রেনে করে এগিয়ে চলা। এক সময় বাটার ফ্লাই পার্কে পৌঁছে যাই। অসংখ্য প্রজাপতি বাটার ফ্লাই পার্কে ওড়াউড়ি করছে। যেন প্রজাপতি বসবাস করার একটি পরিবশে তৈরি করে রাখা হয়েছে। এক কথায় সান্তোজা আইল্যান্ডের পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়ার এটি উপযুক্ত জায়গা। শাটল ট্রেন হু হু করে এগিয়ে চলছে। দু’পাশ দিয়ে পাহাড় আর পাহাড়ের উপরে সারি সারি বৃক্ষরাজি যেন অন্য এক জগত। যে জগতে মানুষ আর প্রকৃতি একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়। প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের রঙিন ছবিগুলো দেখার জন্য মানুষ দূর, বহুদূর থেকে ছুটে আসে। প্রকৃতিকে ক্যামেরায় বন্দী করার জন্য, জীববৈচিত্র্যের নানা দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করার জন্য বিভিন্ন জনের ক্যামেরায় চাপ দেয়ার ক্লিক ক্লিক শব্দ নিঃশব্দ প্রকৃতির জনারণ্যের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিয়ে কোলাহলমুখর করে তুলছে বাটার ফ্লাই পার্কের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলা। নানা ধরনের প্রজাপতি ও নানা রঙের প্রজাপতির ওড়াউড়ি করার দৃশ্যের ছবি তুলতে ব্যস্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকরা। ছোট ছোট গাছের ডাল কিংবা পাতা, বড় বড় গাছের ডাল কিংবা পাতায় প্রজাপতি অবস্থান করার দৃশ্য অবলোকন করছে উপস্থিত সবাই। কারও মাথায়, কারও ঘাড়ে কারও হাতে প্রজাপতিগুলো উড়ে এসে নির্ভয়ে বসছে। এ যেন প্রকৃতির এক অন্যরকম খেলা। যেন প্রজাপতিগুলো অনেক বেশি সাহসী, অনেক অনেক দিনের চেনা। প্রজাপতিগুলো দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, এটি পৃথিবীর অন্য কোন দেশের প্রজাপতি না বাংলাদেশের প্রজাপতি নাকি সিঙ্গাপুরের সান্তোজা আইল্যান্ডের প্রজাপতি। তবে সান্তোজা আইল্যান্ডের এই প্রজাপতিগুলোর মধ্যে অনেক নতুন প্রজাতির প্রজাপতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতির বসবাসের উপযোগী করা হয়েছে। গোটা পৃথিবীতে পনেরো থেকে কুড়ি হাজার প্রজাপতির মধ্যে নানা প্রজাতির বিভিন্ন রং ও বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রজাপতি রয়েছে। আমাদের দেশে এক দশক আগে ছয় শ’ প্রজাতির প্রজাপতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র অল্প কিছু প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। কারণ প্রজাপতির প্রজাতির বিলুপ্ত ঘটছে। তা হলে বাংলাদেশের পরিবেশ কি প্রজাপতি বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এই তিন শ’ প্রজাতির প্রজাপতির মধ্যে ‘গাইডি ব্যারন’ এবং ‘কমন ভেলবেট বব’সহ পঞ্চাশ প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্ত হতে চলেছে। প্রজাপতি হলো সেপিং ড্রোপেট্রা বর্গের এক প্রকার মথ জাতীয় পতঙ্গ। প্রজাপতির দেহ সাধারণত লম্বা হয়ে থাকে এবং তার এই শরীরের সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন রঙের ডানা থাকে। অধিকাংশ প্রজাতির প্রজাপতিই দিবাচর। দিনের বেলায় সূর্যের আলো ঝলমল রোদ্রে মধুর সন্ধানে প্রজাপতিগুলো ফুল হতে ফুলে উড়ে বেড়ায়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাপতির নাম রানী ‘আলোকজান্দ্রার বার্ড উইং’। এ ধরনের প্রজাপতির পাখার বা ডানার আকৃতি ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রজাতির নাম হলো ‘ওয়েস্টার্ন পিগামি ব্লু’। এ ধরনের প্রজাপতি ১ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি দেড় বছর বেঁচে থাকে। আমাদের দেশের উখিয়া, বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় ‘কুমারী লতা’ ও ‘আঙ্গর লতা’ ধ্বংস হওয়ার কারণে প্রজাপতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বনখেকোদের হাতে বন ধ্বংস হওয়ার কারণে অনেক প্রজাতির প্রজাপতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এক সময় আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জে অসংখ্য প্রজাপতি দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রজাপতি আর চোখে পড়ে না। আমরা ছোটবেলায় যখন প্রজাপতি দেখতাম তখন প্রজাপতির পেছনে ছুটতাম। প্রজাপতির বর্ণিল ডানা মনকে আকুল করে তোলে। প্রজাপতিকে ভালবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সে জন্য বাংলাদেশেও প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রজাপতি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। প্রজাপতির বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের মতো বাংলাদেশেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসবে বিভিন্ন রকম প্রজাপতি দেখার জন্য। গণসচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে সব প্রজাতির প্রজাপতি সংরক্ষণ করা সম্ভব। বনের লতাগুল্ম নষ্ট করলে প্রজাপতি তাদের বাসভূমি হারিয়ে ফেলে। প্রজাপতির প্রজনন হুমকির মুখে পড়ে। কাজেই আমাদের গণসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন সেমিনারে লিফলেট, পোস্টার ও সাইন বোর্ডে প্রজাপতি সংরক্ষণের বিভিন্ন বার্তা জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতে হবে। প্রজাপতি নিয়ে আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকগণ অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন। যেমন : প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা আবার প্রজাপতি পাখনা মেলো না। প্রজাপতি নিয়ে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম প্রবাদ আছে। গ্রীকদের ধারণা, একটি মথ থেকে প্রজাপতি বের হয়ে আসাকে মানুষের আত্মার জন্ম হওয়াকে বোঝায়। জাপানীদের ধারণা, যার গৃহে প্রজাপতি আসে তারা ভাগ্যবান। চায়নিজদের ধারণা, একজোড়া প্রজাপতি একসঙ্গে উড়ে যাওয়াকে ভালবাসার দৃশ্য বলা হয়। ইউরোপিয়ানদের ধারণা, প্রজাপতির মধ্যে মানুষের আত্মা বিরাজ করে। সর্বোপরি বাংলাদেশে কোন অবিবাহিত মেয়ে বা ছেলের গায়ে প্রজাপতি বসলে মনে করা হয় সে প্রেমের প্রস্তাব পাবে বা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হবে অথবা বলা হয় যার গৃহে প্রজাপতি আসে সে সুসংবাদ পাবে। যা হোক আরও অনেক দেশে প্রজাপতি নিয়ে নানা ধরনের প্রবাদ রয়েছে। তবে বিশ্বের যে দেশেই হোক না কেন প্রজাপতি দেখলে আনন্দ পায় না বা হাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আবার এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে প্রজাপতি দেখলে প্রজাপতির পেছনে ছোটে না বা ধরার চেষ্টা করে না। যা হোক সিঙ্গাপুরের সান্তোজা আইল্যান্ডে বিখ্যাত বাটার ফ্লাই পার্ক দেখতে গিয়ে আনন্দ ও গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল। সেখানে সংরক্ষিত বেশিরভাগ প্রজাতির প্রজাপতিই বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত এবং সবচেয়ে সুন্দর প্রজাপতিটি আমার সোনার বাংলার। আর একটি বিষয় সিঙ্গাপুরের সান্তোজা আইল্যান্ডে বিখ্যাত বাটার ফ্লাই পার্কের ভেতরে একটি বাটার ফ্লাই মিউজিয়াম রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন দেশের প্রজাপতি মানচিত্রের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও প্রজাপতির বিবরণ রয়েছে। সেখানে গিয়েও আনন্দ ও গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল। সেখানে সংরক্ষিত বেশিরভাগ প্রজাতির প্রজাপতিই বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত এবং সবচেয়ে সুন্দর প্রজাপতিটি আমার সোনার বাংলার, আমার দেশের।
×