ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব;###;দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে

উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৪ নভেম্বর ২০১৬

উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ। মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় ঝোপ-জঙ্গল, ভাসমান নৌকায় নির্যাতিত মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে দুই হাজার নর-নারী কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থানকে মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময় রাষ্ট্রদূতের হাতে বাংলাদেশ সরকারের একটি আনুষ্ঠানিক পত্রও হস্তান্তর করা হয়। একই দিনে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উচ্চ পার্যায়ের দু’টি প্রতিনিধি দল বৈঠক করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানাতে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে সচিব (দ্বিপক্ষীয় ও কনস্যুলার) কামরুল আহসানের সঙ্গে বৈঠক করেন। বেলা সোয়া তিনটায় এ বৈঠক শুরু হয়ে চারটার দিকে তা শেষ হয়। কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আমাদের চরম উদ্বেগের কথা তাদের জানিয়েছি। দাবি করেছি, মিয়ানমারের লোকজন যাতে ফেরত যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা নেয়ার। এ বিষয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের হাতে আনুষ্ঠানিক পত্র তুলে দেয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বৈঠকে কী বলেছেন জানতে চাইলে কামরুল হাসান বলেন, তিনি বরাবরের মতোই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের এসব খবর বানানো। পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, মিয়ানমারের সমস্যা মিয়ানমারকেই সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে যতটুকু করা দরকার মিয়ানমার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ততটুকুই করছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য সমস্যার উৎস কী তা জনতে হবে। এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চলমান উত্তেজনা বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে জানতে চাওয়া হলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতি ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে একাধিকবার বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন। আমি পাঁচবার এই ইস্যুতে সমাধান খোঁজার জন্য মিয়ানমার সফর করেছি। কাউকে যখন জোর করে উচ্ছেদ করা হয়, তখন এর পেছনে কারণ কী তা জানতে হয়। তা না হলে এই সমস্যার সমাধান করা যায় না। কূটনীতিতে সবকিছু বলা যায় না, সবকিছু বলা উচিতও না। এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলবের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সীমান্তে চলমান পরিস্থিতির জন্য ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে একটি বৈঠক করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় ও কনস্যুলার) কামরুল আহসান এই বৈঠক করেন। বৈঠকে কামরুল আহসান মিয়ানমারের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানের পর রাখাইন রাজ্যের আতঙ্কিত স্থানীয় জনগণ বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছেন বলে জানানো হয়। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়, বাংলাদেশ বিষয়টিকে মানবিক বিবেচনায় দেখছে। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী প্রায় এক হাজারের ওপর রাখাইন রাজ্যের নারী, শিশুসহ সাধারণ মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখনও প্রায় হাজারের বেশি মানুষ সীমান্তের ওপর থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে যেন মিয়ানমার সীমান্তের রাখাইন রাজ্যের সাধারণ জনগণ আসতে বাধ্য না হন, সেই ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতাও করার জন্য অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়, মিয়ানমারের সীমান্তের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথাযথ তদন্ত করতে চেয়েছে। সেখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তদন্তের জন্য যে দাবি জানানো হয়েছে, মিয়ানমার সরকারকে সে সুযোগ দেয়া উচিত। এছাড়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম কমিউনিটি যেন সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য না হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া মিয়ানমার থেকে যারা সীমান্ত ক্রস করে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য দাবি জানানো হয়। নিরীহ মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের নিজ গ্রামে পুনর্বাসনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলায় সে দেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্যে ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করেছে তারা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। এদিকে দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এ প্রেক্ষাপটে সীমান্তে বাড়তি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গত কয়েক দিনে কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এ বিষয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বৈঠকও হয়েছে। তিন দশক ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বারবার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এই শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি ও স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, বুধবার সকালে টেকনাফ ও উখিয়া থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে মিয়ানমার থেকে আসা ৬৭ নারী-পুরুষকে আটক করে সে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। বিজিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে, গত ১০ অক্টোবর থেকে বুধবার পর্যন্ত সাত শতাধিক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে সে দেশে পুশব্যাক করা হয়েছে। অপরদিকে, বুধবার কক্সবাজার বিজিবি রেস্ট হাউসে বিজিবি ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপির বৈঠক হয়েছে। দুপুরে এ বৈঠক সমাপ্ত হয়। বৈঠকে বিজিবির পক্ষে নেতৃত্ব দেন সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার খন্দকার ফরিদ হাসান। অপরপক্ষে মিয়ানমারের ৩১ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বর্ডার গার্ড পুলিশের মংডুর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তু সান লিন। এ বৈঠকে ৫টি এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা হয় এবং এটি পূর্বনির্ধারিত বৈঠক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে। বৈঠকে সীমান্তে ইয়াবা, মাদক ব্যবসা ও চোরাচালানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় যে কোন সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণে উভয়পক্ষ একমত হন। বৈঠকে বর্তমান রোহিঙ্গা পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে কিনা তা কোন পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। বার্তা সংস্থা এএফপি রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, মঙ্গলবার এক রাতেই ৫শ’ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়া ২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা নরনারী গত ১০ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এএফপি আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী সীমান্তে কঠোর নজরদারি আরোপ করেছে। কিন্তু এরপরও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে রাতের আঁধারে ঢুকে পড়ছে। আলেয়া খাতুন (৩৮) নামের এক রোহিঙ্গা নারী জানিয়েছে, সীমান্ত অতিক্রমকালে জোহরা নামের আরেক মহিলা তাদের সঙ্গে আসার সময় গোলার বিস্ফোরণে মারা গেছে। আলেয়া খাতুন জোহরার তিন সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কেননা, তাদের দেখার জন্য কেউ নেই। রাখাইন প্রদেশের উত্তর মংডু থেকেই দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। বিজিবির জোরালো টহলদারিকে ফাঁকি দিয়ে এদের অনেকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। যারা এদেশে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশ জুড়ে আশ্রয় নিয়েছে। বুধবার ভোর রাতে উখিয়া ও টেকনাফে পুলিশী অভিযানে ৬৭ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা আটকের সময় গ্রেফতার হয় চার দালাল। এদের উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়নের থাইনখালি, বালুখালি, আবদুর রহমান কাটা ও টেকনাফের হোয়াইকং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং এলাকা থেকে পুলিশ তাদের আটক করে। আটককৃত দালালরা হচ্ছে মোঃ সরোয়ার, মোঃ রফিক, ওসমান গনি ও শাহ আলম। এরা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের সীমান্ত গলিয়ে এদেশে নিয়ে আসার কাজে লিপ্ত রয়েছে। উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের জানিয়েছেন, বুধবার ভোর রাত ও সকালে উখিয়ার থাইনখালি সীমান্ত দিয়ে বেশকিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে ঝোপ জঙ্গলে আত্মগোপন করে। খবর পেয়ে পুলিশ পালংখালির থাইনখালি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ রোহিঙ্গা ও ২ দালালকে আটক করতে সক্ষম হয়। পুলিশ জানায়, টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করছে দালালরা। আটক দালালদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের নিবন্ধিত। এছাড়া টেকনাফ থানার ওসি মোঃ আবদুল মজিদ জানিয়েছেন, বুধবার ভোর রাতে সীমান্তের হোয়াইকং উনচিপ্রাং এলাকা দিয়ে দালালদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের একটি দল অনুপ্রবেশ করেছে খবর পেয়ে অভিযান চালানো হয়। এ সময় একটি ঝুপড়ি ঘরে আত্মগোপন করে থাকা ৮ রোহিঙ্গা ও ২ দালালকে আটক করা হয়। মানবিক কারণে তাদের খাবার ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে। উখিয়ায় আটককৃতদের মধ্যে ১৩ পুরুষ, ১৫ নারী ও ৩৪ শিশু রয়েছে। এদের সকলের বাড়ি মংডুর জাম্বুনিয়া গ্রামে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যা বলছে ॥ বুধবার টেকনাফ থানা পুলিশের হাতে আটক মংডুর রাইম্যারবিল গ্রামের রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ওসমান জানায়, মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, আমার বাবা আবদুল হাকিমকে ধরে নিয়ে আমাদের চোখের সামনে হত্যা করেছে। নুর আলমের পুত্র মোঃ ইয়াছিন জানায়, আমার বোনকে ঘরে ঢুকে ধরে নিয়ে গেছে সেনা সদস্যরা। এ পর্যন্ত তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। টেকনাফ থানায় বসে রোহিঙ্গা একরাম উদ্দিন জানায়, সেনা সদস্যদের ভয়ে আমরা পাহাড়ের পাদদেশে লুকিয়ে ছিলাম। ঘরে যুবক কাউকে না পেয়ে আমাদের সরিয়ে রাখা হয়েছে দাবি করে সেনা সদস্যরা আমার পিতা কলিমুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করেছে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে একই সঙ্গে আমাদের ৭টি বাড়ি। যে যেভাবে পারে প্রাণ রক্ষার্থে আগুনের লেলিহান শিখার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। গত ১৫ দিন ঘরের অদূরে জঙ্গলে আমাদের দিন কেটেছে। একটু সুযোগ হওয়ায় প্রজেক্ট ও খাল সাতরিয়ে নাফনদীর মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাবনে লুকিয়ে থাকি। মঙ্গলবার রাতে জাদিমুরা সীমান্ত পয়েন্ট হয়ে অনুপ্রবেশ করেছি টেকনাফ এলাকায়। অনুপ্রবেশকারী নবী হোসেনের পুত্র জাকের হোছাইন জানায়, তারা দু’দিন আগেও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ধরা পড়েছিল। কোস্টগার্ড তাদের ফিরিয়ে দেয়। নাফনদীতে নৌকায় ভাসমান অবস্থায় থেকে একদির পর ফের অনুপ্রবেশ করেছি। বিজিবির ফেরত দেয়া রোহিঙ্গা ভর্তি একাধিক ছোট ছোট নৌকা নাফ নদীতে কেউড়াবনে লুকিয়ে আছে। তারা মগের মুল্লুকে আর না গিয়ে আবারও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ খুঁজছে। টেকনাফের জাদিমুরা পয়েন্ট দিয়ে রাতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে মিয়ানমারের রাইম্যাবিল, চেংরিপাড়ার মোঃ ইব্রাহিমসহ কেয়ারিপ্রাং ও জাম্বুনিয়ার ১২ পরিবারের অন্তত ৮৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু। তারা স্বজনদের বাসা, শরণার্থী ক্যাম্প ও টালে (অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি) আশ্রয় নিয়েছে বলে জানায় মৌলভী মোঃ হানিফ নামের এক অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের বড়গৌজুবিলের বাসিন্দা আবদুল খালেক জানায়, সেনাবাহিনী আমাদের মূল্যবান মাল লুট ও বাড়িঘর পুড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নি, আমার মেয়ে হাজেরাকে গুম ও ছেলে ইয়াছিনকে হত্যা করেছে। নির্যাতন থেকে বাঁচতে পরিবার পরিজন নিয়ে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি। অনুপ্রবেশকারী আবু আহম্মদ জানায়, মঙ্গল ও বুধবার ২ দিনে প্রায় ৪০ পরিবারের তিন শতাধিক রোহিঙ্গা কুতুপালং বস্তিতে (স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গার টাল) আশ্রয় নিয়েছে। বিজিবি-বিজিপি বৈঠক ॥ কক্সবাজার সেক্টরের বিজিবি রেস্ট হাইসে বেলা ১২টায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) মিয়ানমার কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত মহাপরিচালক, রিজিয়ন কমান্ডার, চট্টগ্রামের দক্ষিণ পূর্ব রিজিয়ন এবং মিয়ানমারের মংডু ১নং বর্ডার গার্ড পুলিশ কমান্ডিং অফিসের উপ-মহাপরিচালকের নেতৃত্বে উভয় দেশের বিজিবি-বিজিপি কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকটিকে উভয়পক্ষ সৌজন্য সাক্ষাত বলে দাবি করেছেন। বৈঠক শেষে বিকেলে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে স্বদেশে ফিরে যান। আবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা ॥ ইতোপূর্বে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার যে বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে তা দুঃখজনক। কিন্তু কোন অবস্থাতেই এদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া সমুচিত হবে না। কেননা, ইতোপূর্বেকার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার মন মানসিকতা রয়েছে। টাকার বিনিময়ে এরা যে কোন অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। ভাড়ায় খাটে নাশকতা ও বেআইনী কাজে। ২০ পয়েন্ট রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে ॥ নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, জলপাইতলী, বাইশারি, উখিয়ার রহমতেরবিল, বালুখালী, পালংখালী, টেকনাফের কেরুনতলী, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, দমদমিয়া, নয়াপাড়া, ঝিমংখালী, সাবরাং, নাজিরপাড়া, জাদিমুরা, শাহপরীর দ্বীপ, খারাংখালী, উলুবনিয়া ও লেদা সীমান্ত পয়েন্টে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়রা। সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে কোস্টগার্ডের নজরদারি ॥ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বুধবার ভোর থেকে টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে নজরদারি আরও বাড়িয়েছে বিজিবি। সঙ্গে যোগ দিয়েছে কোস্টগার্ডও। টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বেশি প্রবেশের চেষ্টা করছে, সেসব পয়েন্টে বিজিবির নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া এর আগে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জিরো লাইন অতিক্রম করে রোহিঙ্গা ভর্তি ২০টি নৌকা অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে ঠেকানো হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাড়ানো হয় সীমান্তে তিন প্লাটুন বিজিবি। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: শফিউল আলম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে আরও বেশি সতর্ক রাখা হয়েছে। গত ৯ অক্টোবর সীমান্তের ওপারে মংডু জেলায় তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহত হয় মিয়ানমারের ৯ পুলিশ। এরপর দিন অর্থাৎ ১০ অক্টোবর থেকে পুরো রাখাইন প্রদেশ বিশেষ করে উত্তর মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’। এতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নরনারীদের। ধর্ষিত হচ্ছে নারী ও যুবতীরা। জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর। রাখাইন মৌলবাদী, সেনা সদস্য, পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীদের নির্মমতা এতই বর্বর যে, টিকতে না পেরে রোহিঙ্গারা দলে দলে দেশান্তরি হচ্ছে। যার বড় একটি চাপ পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে উখিয়ার দুটি শরণার্থী শিবিরে এখনও প্রায় ৩২ হাজার নিবন্ধিত শরণার্থী রয়েছে। যাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা দিয়েও মিয়ানমার সরকার তা পালন করছে না। এছাড়া নিবন্ধিত শরণার্থীর বাইরে পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখে উন্নীত হয়েছে। মিয়ানমার সরকার বরাবরই রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক নয় বলে দাবি করে আসছে। এমনকি তারা রোহিঙ্গা নামে তাদের ডাকতেও সম্পূর্ণ নারাজ। মিয়ানমার তাদের বাঙালী বলে থাকে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শত বছরেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশেও মিয়ানমারের রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি অংশ কক্সবাজার এবং তিন পার্বত্য জেলায় বসবাস করছে। এরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি সকল সুযোগ-সুবিধারও অংশীদার। অথচ, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ভোটার তালিকায় তাদের নাম নেই। রোহিঙ্গাদের সকল কর্মকা-ে আলাদা তদারকি ও নজরদারি বিদ্যমান। যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী বলে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। বিজিবি-বিজিপি’র একমত পোষণ ॥ কক্সবাজার থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, কক্সবাজারে বিজিবির রেস্ট হাউসে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি-বিজিপি) কর্মকর্তা পর্যায়ে সৌজন্য সাক্ষাত অনুষ্ঠানে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল বিজিবিকে উদ্দেশ করে বলেছে, অনুপ্রবেশ রোধে আপনারা আপনাদের সীমান্তে কাজ করেন আর আমরা আমাদের (মিয়ানমার) সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করব। যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় যে কোন সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের কমান্ডার বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণে একমত হওয়া যায়। সৌজন্য সাক্ষাতকালে বিজিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান, তথ্য আদান প্রদান, নিয়মিত সীমান্তে অধিনায়ক পর্যায়ে সৌজন্য সাক্ষাত, যৌথ টহল, বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস, বন্ধুত্বমূলক খেলাধুলার আয়োজন করা এবং অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা করা হয়। বুধবার বেলা বারোটায় বিজিবির রেস্ট হাউসে এই বৈঠকে মিয়ানমারের ৩১ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মিয়ানমারের মংডু ১নং বিজিপি কমান্ডিং অফিসের উপ-মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তু সান লিন। বাংলাদেশের পক্ষে ২৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খোন্দকার ফরিদ হাসান। এর আগে সকাল সাতটায় টেকনাফ স্থলবন্দরে এসে পৌঁছালে বিজিপি প্রতিনিধিদলকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্মকর্তারা তাদের অভ্যর্থনা জানান। বিকেল আড়াই টায় সৌজন্য সাক্ষাত বৈঠক শেষে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল কক্সবাজার শহরের একটি মার্কেটে শপিং শেষে বিকেল চারটায় টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে মিয়ানমারে ফিরে যান।
×