ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেপরোয়া পুলিশ- ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়াচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২১ নভেম্বর ২০১৬

বেপরোয়া পুলিশ- ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়াচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ এ যেন শর্ষেতেই ভূত! খুন, অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, নারী কেলেঙ্কারির মতো ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ। গত ২ বছরে প্রায় ২১ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গুরুদ-, লঘুদ-, বাধ্যতামূলক অবসর এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মতো ঘটনা। সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য রয়েছেন, যাদের সিনিয়রিটি নিচে নামিয়ে দেয়া, র‌্যাংকব্যাজ এক ধাপ অবনমন করা এবং চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়। বাকিদের মৌখিকভাবে সতর্কীকরণ, বেতন-ভাতা কর্তন এবং তিরস্কারসহ বিভিন্ন ছোটখাটো সাজা দেয়া হয়েছে। তবে চলতি বছরের শুরুতে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যার লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী এই চিত্র ফুটে ওঠেছে। গত শুক্রবার ছিনতাইকালে দুই পুলিশ কনস্টেবল ধরা পড়ার ঘটনা ছাড়াও চলতি নবেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পুলিশের দায়িত্বে গাফিলতির কারণে রাজধানীর বাড্ডায় গারো তরুণী ধর্ষণের মূল হোতা রাফসান হোসেন রুবেলকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানোর পর পুলিশ পাহারা থাকা অবস্থায় সেখান থেকে পালিয়ে যায় হাতকড়া পরিহিত আসামি রুবেল। তারপর রুবেলকে আবারও গ্রেফতার করা হয়। দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কাওরান বাজারে বিএসইসি ভবনে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ জানান, রুবেল বাড্ডা এলাকার চিহ্নিত অপরাধী। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে বাড্ডা, রামপুরা থানায় নয়টি চাঁদাবাজি, অস্ত্র, ডাকাতি ও ধর্ষণ মামলা পাওয়া গেছে। রুবেল ও তার সহযোগীরা সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে বখরা হাতিয়ে নিতেন। ২৫ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ওই গারো তরুণী তার হবু স্বামী রিপন ম্রংয়ের সঙ্গে দেখা করতে বাড্ডার হাসান উদ্দীন সড়কে হাজী রুহুল আমিনের মেসে গিয়েছিলেন। রিপন ম্রংয়ের কাছে মহিলা আসার কথিত অপরাধের দফারফা করার অজুহাতে ম্রংয়ের কাছে থাকা ১৭ হাজার টাকা এবং তার ব্যবহৃত স্মার্টফোনটি ছিনিয়ে নেন। কিছু সময় পর রুবেল ও তার সহযোগীরা ওই তরুণীকে পাশের পারভেজের রিকশার গ্যারেজের পাশে হাজী মোশারফ মিয়ার পরিত্যক্ত বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করেন। ধর্ষক রুবেলকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পাশাপাশি দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে ঢাকা মহনগর পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে। এর আগে আগস্টে বগুড়া ধুনট উপজেলার বানিয়াগাতি জামে মসজিদের ইমাম মতিউর রহমান হত্যা মামলার গ্রেফতারকৃত আসামি আনিছুর রহমান (৪২) হাতকড়াসহ পুলিশ হেফাজত থেকে পালিয়েছে। তাকে আদালতে নেয়ার পথে শাজাহানপুর উপজেলার একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে তিনি পালিয়ে যান। আনিছুর রহমানের বাবার নাম মৃত মহসিন আলম। ধুনট উপজেলার বানিয়াগাতি গ্রামে তাদের বাড়ি। তিনি একই উপজেলার মহিশুরা দাখিল মাদ্রাসার অফিস সহকারী ছিলেন বলে জানা গেছে। ধুনট থানা থেকে হাতকড়া পরা অবস্থায় আসামি আনিছুরকে কনস্টেবল হাসেম আলী ও আজাদের মাধ্যমে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় বগুড়ার আদালতের উদ্দেশ্যে পাঠানো পর অটোরিকশার গ্যাস নেয়ার সময় পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে আসামি আনিছুর পালিয়ে যায়। আগস্ট মাসেই শরীয়তপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে সামাদ মাদবর (৩৫) নামে এক মাদক মামলার আসামি হাতকড়াসহ পালিয়ে গেছে। শরীয়তপুর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে যায়। সামাদ মাদবর শরীয়তপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ শৌলা গ্রামের আফসার মাদবরের ছেলে। গত শুক্রবার যশোরে পুলিশের বিরুদ্ধে এক যুবককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। নিহত যুবকের নাম জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)। গত শুক্রবার রাত তিনটার দিকে যশোর-ঝিনাইদহ মহাসড়কে যশোর সদর উপজেলার দৌলতদিহি এলাকায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, জাহাঙ্গীরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পুলিশ হত্যা করেছে। ছোট ভাই আবিদ হাসান ওরফে টুটুলকেও (২৭) ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। তবে যশোর কোতোয়ালি থানা-পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, ডাকাতি করতে গিয়ে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে জাহাঙ্গীর নিহত হয়েছেন। পুলিশের মাঠপর্যায়ে অসাধু পুলিশ কর্মকর্তারা মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, স্বর্ণ লুট ও ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন পুলিশের বিভিন্ন দফতরের একের পর এক অভিযোগ জমা হচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১২টি অভিযোগ শুধু পুলিশ সদর দফতরেই জমা পড়ে। প্রতিমাসে সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ অভিযোগ জমা হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অনেকেই নানাভাবে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে, আবার অনেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ করছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পোস্টিং ও পদোন্নতির কারণে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের কোন সদস্যের অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠান বা বাহিনী নেবে না। একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীতে অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। দোষী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। অতীতে বিভিন্ন অপকর্মের দায়ে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কোন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরা যেন কোন অপকর্মে লিপ্ত হতে না পারে, সেজন্য নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদস্যরা যেন কোন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হতে না পারে, সেজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা।
×