ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গৌরব জি পাথাং

‘ভেতরে সবার সমান রাঙা’

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

‘ভেতরে সবার সমান রাঙা’

এ দেশে সূর্য অস্তমিত হয় আজান, ঘণ্টা আর উলু ধ্বনিতে; আবার রাতও ভাঙে সেই একই সুরধ্বনিতে। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। মরমী সাধক লালন শাহ্, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাদের গান, সাহিত্য ও বক্তৃতায় জাগরিত করেছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান-/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রীস্টান/ গাহি সাম্যের গান! অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ও উদ্বুদ্ধ এ দেশের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান। বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী ও আদিবাসী সকলেই নতুন এক অসাম্প্রদায়িক দেশের আশায় মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। শুধু তাই নয়, এই দেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সব ধর্মের মানুষ এবং বাঙালী জাতির পাশাপাশি এ দেশে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা যুগ যুগ ধরে একত্রে বসবাস করে আসছে। তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি বাংলার কৃষ্টি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে আসছে। এ দেশের ধর্মীয় পূজা-পার্বণ ও উৎসবাদি সম্প্রীতির মিলনস্থল। মুসলিমদের ঈদ, হিন্দুদের দুর্গা পূজা, জন্মাষ্টমী, বৌদ্ধদের বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও ফানুস উড়ানো উৎসব, খ্রীস্টানদের বড়দিন ও পুনরুত্থান দিবসÑ এসব ধর্মীয় উৎসব যেন সকলেরই উৎসব। প্রত্যেকেই প্রতেক্যের জন্য প্রার্থনা করে, পরস্পরকে নিমন্ত্রণ এবং পূজা-পার্বণে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু মাঝে মাঝে এই সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত আসে; যা দেশ ও জাতির উন্নতি এবং সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করে দিতে চায়। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ২০১২ খ্রীস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু ও তার আশপাশের এলাকায় ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির ধর্মান্ধরা পুড়িয়ে দিয়েছিল। এ বছর ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির ও দেড় শতাধিক ঘরবাড়ি ধর্মান্ধরা পুড়িয়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহ পরই ৬ নবেম্বর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ এলাকায় কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। এখনও অনেক নারী পুরুষ ও শিশু খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন, কেউবা আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন। যে বাংলাদেশ মিলন ও সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ, সেই দেশ বারবার ধর্মান্ধদের দ্বারা অশান্তি ও ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হচ্ছে। যে দেশে হাজার বছর ধরে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টধর্মের লোকেরা সহাবস্থান করে আসছে। পূজা-পার্বণে, ঈদে, বড়দিনে, বৌদ্ধ পূর্ণিমায় তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে, সুখে-দুঃখে ও দুঃসময়ে কিংবা বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়; যে দেশে বাঙালীর বৈশাখী, বসন্ত এবং পৌষ উৎসব। আদিবাসীদের বৈসাবি, গারোদের ওয়ানগালা, ওরাওদের কারাম উৎসব প্রভৃতি বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়; সেই দেশে কেন বারবার ধর্মীয় সংঘাত, ধর্মীয় সহিংসতা দেখা দেয়? কেন বারবার পুড়ে যায় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, মন্দির ও গির্জা? ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অনুদারতা, অনমনীয়তা, অসহনশীলতা, অগ্রহণীয়তা ইত্যাদি সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িকতার অন্তরায়। এই বাধা আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সকল মানুষকে ও সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে হবে। সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা রেখে গেছেন, সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের মাঝে জাগরিত হোক। রামপুরা, ঢাকা থেকে
×