ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বাঙ্গে যার ক্ষত

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৭ নভেম্বর ২০১৬

সর্বাঙ্গে যার ক্ষত

পৃথিবী ছোট করে আনার সেøাগানে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির পৃথিবীর অনিবার্য কারণেই ছোট হয়ে এসেছে। তার দিগন্ত আর প্রসারিত হওয়ার কোন সম্ভাবনার দেখা মিলছে না। অবশ্য তা বিস্তৃত হোক, এমনটা বোধকরি কেউ চাইছেও না। ফলে ক্ষুদ্র পরিসরে তাকে ঠাঁই নিতে হচ্ছে যেন। দায়িত্বহীনতা অনিয়ম নীতিহীনতা সবকিছু তাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে, সেসব ছিন্ন ভিন্ন করে ছাদ ফুঁড়ে আকাশের পানে ছুটে যাওয়ার চাপ আর অনুভব করে না। কেবলই কানামাছি আর কেবলই অন্ধকার এসে তাকে তুলে নেয় ক্রোড়ে। কিন্তু শুশ্রুষা আর হয় না। অসুখ-বিসুখ তার সর্বাঙ্গে। মলমেও শুকায় না ঘা। তবু শ্বেতহস্তির মতো তাকে পুষতে হয় কাঁড়ি কাঁড়ি রাশি রাশি অর্থকড়িতে। ভর্তুকির মধ্যে খায় ঘুরপাক। অথচ অজস্র মুদ্রা আয়ের কথা তারই। দিনের পর দিন অব্যবস্থাপনায় বেড়ে ওঠা, সঙ্কুচিত বা প্রসারিত হতে থাকা তার সর্বাঙ্গে রোগজীবাণু আর ব্যাধি বাসা বেঁধে রেখেছে। দুর্নীতির রাহুগ্রাস বা করাল গ্রাস, যা-ই বলা হোক না কেন, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবেই গ্রোথিত হয়ে গেছে যে, স্বাভাবিক নিয়মে তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স নামক একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থাটি কয়েক দশক ধরেই সমস্যা আর সমস্যার পাহাড় নির্মাণ করে চলছে। প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়মই পরিণত হয়েছে নিয়মে। অপকর্মের হোতারা বিরাজ করছে সর্বত্র তার দোর্দ- প্রতাপে। পরিস্থিতি যেদিকে ধাবিত, তাতে মৃত্যুঘণ্টা বেজে যাওয়ার সুনসান আয়োজনই দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। বিমানের কর্মচারীদের প্রভাব প্রতিপত্তি দাপট স্বাভাবিকভাবে বিনষ্ট করছে, এমন অভিযোগ বহুকালের। বিমান মাথা উঁচু করে দাঁড়াকÑ এটা সবার কাম্য হলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমানকালে পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একপ্রান্ত থেকে মানুষ অন্যপ্রান্তে ছুটে যাচ্ছে। আকাশপথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের পরিমাণ বাড়ছে দ্রুতগতিতে। একই সঙ্গে বাড়ছে পরিবহন সংস্থা। যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমনি ব্যক্তি মালিকানায়। অধিকাংশ সংস্থাই পরিচালিত হচ্ছে লাভজনকভাবে। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কেবলই লোকসান দিচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা কেন, সে প্রশ্নের জবাব দেয়ারও যেন নেই কেউ। অথচ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ প্রতিনিয়ত ঢালতে হচ্ছে কেবল সংস্থাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সংস্থাটির অবকাঠামোও সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বছর দুয়েক আগেও সাড়ে সাত শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি সংস্থাটির। তবে অর্থের একটা বড় অংশই কর্মকর্তাদের পকেট ভারি করার কাজে সহায়ক হয়েছে। সংস্থাটির এমন কোন শাখা-প্রশাখা নেই যেখানে লাগামহীন দুর্নীতিমুক্ত অবস্থার সন্ধান মেলে। বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, কেনাকাটা, খাবার সরবরাহ, লোক নিয়োগ তথা সব শাখায়ই রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এরা জেঁকে বসে আছে। তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতেও উঠে এসেছে এদের ভয়াবহ অপরাধ চিত্রসমূহ। আধুনিক কৌশল ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাত্রীসেবা প্রদান করে সুনাম ও মুনাফা অর্জন তো পরের ব্যাপার, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই তাকে নিরন্তর চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সমুদয় সম্ভাবনাকে গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বিনষ্ট করতে করতে এখন প্রায় খাদের কিনারে। সেবার মান বাড়াতে প্রতিষ্ঠানটিকে লিমিটেড কোম্পানি করেও সেবার মান, দক্ষতা, স্বচ্ছতা কোনটিই বাড়ানো যায়নি। বছরে নতুন বিমান সংযোজন করার পরও সঙ্কটের মেঘ থেকে বেরোতে পারেনি। লাল-সবুজ পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটির খোলনলচে বদলানো না গেলে অর্থকড়ি ঢেলেও বা বিদেশী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েও কোন ফলোদয় হবে না। যাত্রীসাধারণসহ সবার আশা, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে অসাধু সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটন করে বিমানকে রক্ষা করা হোক।
×