ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারাকেশ সম্মেলনে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ॥ পানি বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বৈশ্বিক তহবিল গঠনের প্রস্তাব

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় চাই ॥ ঐক্যবদ্ধ লড়াই

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ১৬ নভেম্বর ২০১৬

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় চাই ॥ ঐক্যবদ্ধ লড়াই

কাওসার রহমান, মারাকেশ, মরক্কো থেকে ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাবমান হুমকির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার রাতে মারাকেশ জলবায়ু সম্মেলনের হাইলেভেল সেগমেন্টে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের এই দুর্লভ মুহূর্তে আসুন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গড়ে তুলি নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী। সবাই সমান দায়িত্ব নিয়ে গড়ে তুলি আমাদের প্রতিশ্রুত এক সুন্দর পৃথিবী।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অভিবাসনের ইস্যুর ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের অভিবাসনের চ্যালেঞ্জটি সঠিকভাবে মোকাবেলা করা না হলে আমরা কখনই টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হব না। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদ খাবার পানি, স্যানিটেশনের বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই নিরাপদ খাবার পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আসুন আমরা পানি বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠন করি। এ তহবিলের অর্থ পানি বিষয়ে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের কাজে ব্যবহার করা হবে।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের পানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে পানি বিষয়ে জাতিসংঘের এ্যাকশন প্ল্যানের প্রতি তার সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। দুপুরে প্ল্যানারি অধিবেশনের উদ্বোধনের পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হয় সম্মলনের হাইলেভেল সেগমেন্ট। এ সেগমেন্টে একে একে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও মন্ত্রীরা বক্তব্য রাখেন। গভীর রাত পর্যন্ত এ বক্তব্য চলতে থাকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪৯তম বক্তা হিসেবে বাংলাদেশ সময় গভীর রাতে মঞ্চে বক্তব্য দিতে ওঠেন। এ সময় তিনি বলেন, এবারের সম্মেলন আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। আমরা এ বছর ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তির কার্যকর উদযাপন করছি। গত বছর আমরা প্যারিসে সফলভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় একটি অর্থবহ ভিত তৈরি করতে সমর্থ হয়েছি। এখন সময় আমাদের ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেয়া। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আমাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হলে লাখ লাখ মানুষের জীবন এবং জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। বাংলাদেশ হচ্ছে প্যারিস চুক্তি অনুমোদনকারী প্রথম দেশগুলোর একটি। এছাড়া আমরাই প্রথম জলবায়ু পরির্বতনে নিজস্ব অর্থে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। এ পর্যন্ত আমরা এ তহবিলের নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছি। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো উচ্চমাত্রার ঝুঁকি সত্ত্বেও আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাফল্য অর্জন করেছি। এ সাফল্যের মধ্যে রয়েছে- আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং নদী শাসনের মতো কার্যক্রম গ্রহণ, যা ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পূর্ববর্তী খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মারাকেশ জলবায়ু সম্মেলনে এসে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দুপুরে তিনি জলবায়ু সম্মেলনের প্লেনারি অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মরক্কোর বাদশা ষষ্ঠ মোহাম্মেদ এই প্লেনারি অধিবেশনের উদ্বোধন করেন। জলবায়ু সম্মেলনের প্লেনারি অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের ৮০টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান যোগ দিয়েছেন। সম্মেলনের উদ্বোধন করতে গিয়ে মরক্কোর বাদশা পুরো মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে হাতে হাত মিলিয়ে ধরিত্রী রক্ষায় কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে মরক্কো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গ্রীন হাউস গ্যাসের প্রভাব থেকে মানব জাতিকে রক্ষার জন্য প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে। আফ্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং তা মোকাবেলা করে আফ্রিকা জনগণের টিকে থাকার সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে সম্মেলনের শুরুতে একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক হওয়ার জন্য সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের প্রতি আহ্বান জানান। জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উপস্থিতিকে আলোচনায় অনুঘটকের মতো কাজ করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক পরিবেশ মন্ত্রী এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মারাকেশ জলবায়ু সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সব সময় জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে এসেছেন। এবারের সম্মেলনেও তার উপস্থিতি জলবায়ু আলোচনায় অনুঘটকের মতো কাজ করছে বলে তিনি জানান। যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার গুজব ॥ প্লেনারি অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগেই সম্মেলন কেন্দ্রে গুজব ছড়িয়ে পড়ে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাচ্ছে। এ খবরে বিভিন্ন দেশের সরকারী প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটি ও সাংবাদিকদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। অবশ্য সরকারী কর্মকর্তারা এ গুজবকে উড়িয়ে দেন। কারণ এখনও ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। ওবামা প্রশাসন ক্ষমতায় রয়েছে। আর জলবায়ু সম্মেলনেও যোগ দিচ্ছেন ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। ওবামা প্রশাসন ইতোমধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুমোদন করেছে। ফলে এ গুজবের সত্যতা নেই। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও সকালে জলবায়ু সম্মেলনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনে বিশ্ব রাজনীতি বা অর্থনীতিতে কোন প্রভাব ফেলবে না। বরং নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় অনেক কিছুই ইতিবাচক মোড় নেবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১১০টি দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুমোদন করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ কার্বন নির্গমনকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রও এই চুক্তি অনুমোদন করেছে। ফলে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ কম। তাছাড়া নির্বাচনের সময় অনেক প্রার্থীই নানা কথা বলে থাকে। তা সত্য বলে ধরার কোন কারণ নেই। তিনি আশা করেন, দায়িত্ব নেয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনের আগে দেয়া বক্তব্য থেকে সরে আসবেন। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কাঠামো সনদ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাবার আশঙ্কার সংবাদে গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ২০০টি বেসরকারী সংগঠনের জোট গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান (সিএসআরএল)-এর সভাপতি জিয়াউল হক মুক্তা। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কাঠামো সনদ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসারণ হবে বিশ্বব্যাপী বিকশিত চরমপন্থার কাছে মার্কিন প্রশাসনের আত্মঘাতী আত্মসমর্পণ। যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিটের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর আঘাতের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ হবে বহুপাক্ষিকতার ওপর কুঠারাঘাত। তিনি বলেন, বহুপাক্ষিকতার মঞ্চ পরিত্যাগ করা হবে একপাক্ষিকতার মাধ্যমে চরমপন্থা বিকাশের সম্ভাবনাকে উৎসাহিত করা। চরমপন্থার মতাদর্শ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হিসেবে কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় যে বিপর্যয়ের সূচনা হবে, সেখান থেকে উত্তরণে সহযোগিতা করার পরিবর্তে সে প্রক্রিয়াকে ব্যাপকতর করার কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও অংশগ্রহণ হবে মানবতার সঙ্গে শত্রুতার নামান্তর। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মানে মরক্কোর বাদশার দেয়া মধ্যাহ্ন ভোজে যোগ দেন।
×