ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০১, ১৫ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

অক্সফোর্ডের পড়াশোনা পদ্ধতি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে ক্লাসে বক্তৃতা শোনার বাধ্যবাধকতা ছিল না। আমার দু’জন টিউটর ছিলেন অর্থনীতিতেÑ পল স্ট্রিটেন এবং রাজনীতিতে জন কলিন্স। তাদের সঙ্গে প্রতি সপ্তায়ই একটি আসরে বসতে এবং প্রবন্ধ পাঠ করতে হতো। এই প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনাই ছিল অধিকতর পড়াশোনার জন্য দিকনির্দেশনার সূত্র। মাঝে মাঝে টিউটর বলতেন, ওই সেমিনারে অংশ নিলে বা বক্তৃতা শুনলে কাজে লাগবে। তবে তাদের প্রধান কাজ ছিল প্রতিদিনের আলাপ-আলোচনার পর পরবর্তী সময়ের জন্য একটি রিডিং লিস্ট দেয়া- পড়াশোনার বই বা প্রবন্ধের ফর্দ দেয়া এবং নানা উপায়ে পরীক্ষা করা যে, আমি কি সেগুলো পড়েছি? আমার মনে হয় আমি অক্সফোর্ডে ৯ মাস গভীর পড়াশোনা করি এবং নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভের প্রচেষ্টা চালাই। বেলিওলের ছোট একটি লাইব্রেরি ছাড়াও আমার কাছেই ছিল বোডলিয়ানের বৃহৎ লাইব্রেরি। আমি সেই লাইব্রেরিতে শুধু পড়তে যেতাম না, মাঝে মাঝে সেখানে ছোটখাটো ঘুমও দিতাম। বোডলিয়ানের পাশেই ছিল ম্যাক্সওয়েলের একটি বইয়ের দোকান। আমি সেখানেও অনেক সময় কাটাতাম এবং ব্যাপক হারে বই খরিদ করতাম। তবে বই খরিদের বিশেষ জায়গা ছিল বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন গ্রন্থাগারে অথবা মেলায় নতুন এবং পুরনো বইয়ের বিক্রয় মেলা। আর লন্ডনে ফয়েলস ছিল বই কেনার অথবা দেখার অতি বৃহৎ একটি লাইব্রেরি। লন্ডনের রাসেল স্ট্রিটে নতুন বা পুরনো বই কেনার মেলা প্রায়ই অনুষ্ঠিত হতো। আমরা অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজে ২১ জন সিএসপি কর্মকর্তা পড়াশোনা করতাম। সাধারণ ছাত্রদের তুলনায় আমরা অনেক বেশি মাসোহারা পেতাম। যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল আমাদের মাসে সম্ভবত ৪২ পাউন্ড দিত। আমরা তার ওপরে আমাদের বেতন হিসেবে পাকিস্তান সরকার থেকে পেতাম আরও প্রায় ২৭ পাউন্ড। আমাদের বিভিন্ন ফিস ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিলই দিয়ে দিত। তাই আমাদের খরচ ছিল শুধু বাসস্থান, খাওয়া এবং ঘোরাফেরার জন্য। আমাদের অনেকেই এই মাসোহারা থেকে যথেষ্ট সঞ্চয় করে তার সঙ্গে আরও প্রায় ১০০ পাউন্ড যোগ দিয়ে গাড়ি কিনে দেশে নিয়ে আসত। আমারও ইচ্ছা ছিল সে রকম এবং সে জন্য আমি দেশ ছাড়ার সময় আমার বন্ধু আবু সাঈদ মাহমুদের সহায়তায় ৯১ পাউন্ড আমার সঙ্গে নিয়ে যাই। অক্সফোর্ডে পৌঁছেই আমি কান্দাওয়ালা এজেন্সিকে আমার জন্য মরিস মাইনর গাড়ি খরিদের হুকুম দিই। কান্দাওয়ালা এজেন্সি ছিল করাচীতে মরিস মাইনর গাড়ির এজেন্ট। অক্সফোর্ডে থাকতে মাঝে মাঝেই আমরা লন্ডন যেতাম এবং প্রতিটি টার্মের শেষে ব্রিটিশ কাউন্সিল আমাদের জন্য আরও কিছু কার্যক্রমের ব্যবস্থা করত। প্রথম টার্মের শেষে আমরা বৃহত্তর লন্ডনের বেথনাল গ্রীন এলাকায় সেখানকার সার্বিক পুনর্গঠন প্রকল্প পরখ করলাম। বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের পুনর্বাসনের জন্য এই প্রকল্পটি তখন চলছিল। এই বেথনাল গ্রীন এলাকায়ই বর্তমানে বাংলা টাউন। দ্বিতীয় টার্মের শেষে আমরা বিলেতের বিভিন্ন কাউন্টি প্রশাসন পরখ করি। আমি ছিলাম গ্লাসগোর পেইজলি কাউন্টিতে। শেষ টার্মের পরে আমরা উত্তর আয়ারল্যান্ডে সেখানকার প্রশাসন সম্বন্ধে অবহিত হতে সেখানে কিছুদিন কাটাই। সেই সূত্রে আমরা বেলফাস্টে কিছুদিন অতিবাহিত করি। আগেই বলেছি যে, ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাই আমি দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ট্রেনযোগে লন্ডন ত্যাগ করি। ১৯৫৭ সালে বিজ্ঞানের জগতে এক অচিন্তনীয় অর্জন হয়। মানুষের মহাকাশ বিজয়। ৪ অক্টোবর রাশিয়া স্পুটনিক নামক গবেষণা যানকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়। ইউরি গ্যাগারিন নামের রাশিয়ার একজন বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিলে াড়ংঃড়শ নামের ংঢ়ধপব পৎধভঃ-এ করে পৃথিবীর প্রথম মানব হিসেবে মহাকাশে সফর করলেন। এই বিখ্যাত ব্যক্তি ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মহাকাশ বিজয়ের সাফল্য সারা পৃথিবীকে বিস্ময় ও গর্বে আপ্লুত করে। একই সঙ্গে শীতলযুদ্ধের যুগে অকস্মাত রাশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব সকলের নজর কাড়ে। আমেরিকায় নতুন উৎসাহে মহাকাশ বিজয়ের কার্যক্রম জোরদার হয়। আকাশের দিকে চেয়ে স্পুটনিক দেখা একটি কৃতিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমার সেই সৌভাগ্য অনেক দেরিতে হয়। আমি অক্সফোর্ডে পৌঁছার বেশ পরে প্রথম স্পুটনিকের স্ফুলিঙ্গের দর্শন পেলাম। ১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন এস্ট্রোনট জন গ্লেন (পরবর্তীকালে সিনেটর গ্লেন) হন প্রথম ব্যক্তি যিনি সারা পৃথিবী চার ঘণ্টায় মহাকাশ থেকে পরিভ্রমণ করেন (ড়ৎনরঃ ঃযব বধৎঃয)। মহাকাশ বিজয় আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের হতাশা সৃষ্টি করে। আমি মহাকাশ নিয়ে লেখা অনেক গল্প উপন্যাস এবং রহস্য সাহিত্যে বিশেষভাবে আকৃষ্ট ছিলাম। আমার মনে হলো এখন এইসব সাহিত্য সৃষ্টি দারুণ ধাক্কা খাবে। কল্পনার লাগামে এখন টান পড়বে। এটম বোমার বিস্ফোরণের পর সম্ভবত মহাকাশ বিজয় হয় সমমানের একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এবং একই সঙ্গে মানবসভ্যতার একটি অসাধারণ মাইলফলক। ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাই থেকে সম্ভবত ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ঘুরে বেড়াই। প্রথমেই গেলাম ফ্রান্সের প্যারিসে, সেখান থেকে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক শিল্প মেলা সেখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ব্রাসেলসে আমাকে বেশ ক’দিন থাকতে হয়। সে কাহিনী কিছু পরেই বলব। ব্রাসেলস ছেড়ে গেলাম জার্মানির কোলনে, তারপর বনে। বন থেকে জাহাজে চড়ে রাইন নদী ও রাইন পাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। মাইনজে নেমে আবার ট্রেন হলো আমার বাহন। জুরিখ থেকে গেলাম বের্নে, আবার ফিরলাম লুসার্ন, মনত্রো, রসেরনায়ের, মাউন্ট কো ইত্যাদি বেরিয়ে জেনেভায়। সেখান থেকে আবার ফিরে গেলাম ফ্রান্সে। গেনেভে আমার বান্ধবী মুনিমুন্নেসা ও তার স্বামীর সঙ্গে প্রায় সাত দিন। শুধু ঘোরাফেরা আর বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করে কাটল এই ক’দিন। পরবর্তী গন্তব্যস্থল হলো ক্রমান্বয়ে ইতালির টরিনো, পিসা, রোম, নেপলস ও ফ্লোরেন্স, মিলান হয়ে ভেনিসে। সেখান থেকে বেলগ্রেড, ঝাগরেভ হয়ে এথেন্স। অতঃপর ইস্তান্বুুল, আঙ্কারা হয়ে বাগদাদ ও বসরা। বসরায় বেশ অপেক্ষা করার পর বিপ্লবী ইরাক ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিকে বসরা, করাচী, বোম্বাই সার্ভিস পুনরায় চালু করতে হুকুম দিল। মনে রাখা ভাল যে, ১৪ জুলাই এক রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরাকে যুবরাজ ফয়সালকে হত্যা করে জেনারেল করিম কাসেম সেখানে সামরিক সরকার গঠন করেন। প্রায় সাতদিন জাহাজে করে বেশ ক’টি ঘাটে থেমে- দোহা, বাহরাইন, দুবাই, গোয়াধর হয়ে করাচীতে নামলাম সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। ব্রাসেলস যাই প্যারিস থেকে, উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শিল্পমেলা পরিদর্শন এবং বেলজিয়ামের জাতীয় দিবসের উৎসবে অংশগ্রহণ। আন্তর্জাতিক মেলার জন্য ব্রাসেলসে তখন পরিব্রাজকদের ভিড়। আগেভাগেই আমি আমার বাসস্থানের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। লজেক্সপো আমাকে এক বাড়িওয়ালীর একটি কামরায় থাকবার ব্যবস্থা করেছিল। তাদের নির্দেশমতো আমি সকালেই সেখানে হাজির হলাম। বাড়িওয়ালী আমাকে নাশতা খাইয়ে ব্রাসেলসের কেন্দ্রস্থল ও শিল্পমেলায় যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিল। একটি নির্দিষ্ট ট্রামলাইনে আমি দুটি জায়গায়ই যেতে পারি। প্রথম দিনেই শিল্পমেলায় চলে গেলাম এবং সারাদিন সেখানে কাটালাম। বেলজিয়ামের খাবার ফরাসী খাবারের মতোই সুস্বাদু। দ্বিতীয় দিনে আমি প্রথমে গেলাম ব্রাসেলসের কেন্দ্রস্থলে। সেখানে সেদিন জাতীয় দিবস উপলক্ষে ছিল র‌্যালি এবং সামরিক কুচকাওয়াজ। বেলজিয়ামের উপনিবেশ ছিল আফ্রিকায়। তাই কুচকাওয়াজে ছিল কয়েকটি আফ্রিকান সামরিক ইউনিটের মার্চ ও বাদ্যযন্ত্রের মহড়া। সেদিন পাকিস্তান দূতাবাসে আমার বন্ধু আকরাম জাকির খোঁজ নিলাম। আকরাম জাকি বেলজিয়ামে ছিলেন তৃতীয় সচিব আর সেখানে রাষ্ট্রদূত ছিলেন বগুড়ার রাজনৈতিক নেতা হাবিবুর রহমান। আকরাম জাকি তার বাড়িতে যেতে বলল। তার ছিল আনন্দ উৎসব। সদ্য তার একটি মেয়ে জন্ম নিয়েছে এবং মা ও কন্যা সেদিনই হাসপাতাল থেকে বাড়ি প্রত্যাবর্তন করেছিল। আকরাম জাকি পাঞ্জাবের মানুষ, ছাত্রাবস্থায় ঢাকায় এসেছিল এক ছাত্রদলের সঙ্গে এবং সেখানে তার দেখাশোনার সুযোগ হয় আমার। সে আবার সিলেটেও গিয়েছিল এবং আমার পরিবারের সঙ্গে সেখানে পরিচিত হয়। সে আমার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেয় এবং ব্রাসেলসে ছিল তার প্রথম দূতাবাসে নিযুক্তি। তৃতীয় দিনও আমার ব্রাসেলসে থাকবার কথা ছিল এবং পরের দিন ট্রেনযোগে কোলন যাবার ভ্রমণসূচী ছিল। যাবার দিন সন্ধ্যাবেলা আমি রেলস্টেশনে হাজির, ট্রেনে চড়বার জন্য প্রস্তুত। সহসা মনে হলো আমার প্যান্টের পেছনের পকেট কেমন যেন পাতলা। এই পকেটে ছিল একটি মানিব্যাগ, পাসপোর্ট এবং আমার ট্রেন টিকেটের বই। সম্ভবত মালপত্র নিয়ে আমি যখন টানাটানি করি তখন এগুলো কোথাও পড়ে গেছে। আমি সযতনে মনে করলাম যে কোথায় কোথায় রেলস্টেশনে ঘুরেছি। সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিলাম বিশেষ করে বাথরুমে- যদি কোথাও পড়ে থাকে সেই আশায়। এ ছাড়া রেলস্টেশনের কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি ঘোষণাও দিলাম তবে সেইটি দিতে বেশ দেরি হয়ে যায়। আমার ট্রেন যথাসময়ে স্টেশন ছাড়ল, আমি ব্রাসেলসে রয়ে গেলাম। রাত দুপুর পর্যন্ত আমি খোঁজাখুঁজি চালালাম। অবশেষে লজেক্সপোর রেলস্টেশনের দফতরে গিয়ে আমার ৩-৪ দিনের জন্য থাকার জায়গা খুঁজে দিতে বললাম। তারা ইক্সেলেসে আমার জন্য একটি ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলো। কি করে সেখানে যাব তার বিস্তৃত দিকনির্দেশনা লজেক্সপোই ইংরেজীতে লিখে দিল। আমি অবশেষে মধ্যরাতে আমার বাসস্থানে গেলাম। ইক্সেলেস ব্রাসেলসের এক রকম সহোদর শহর, রেলস্টেশন থেকে ট্রামযোগে প্রায় ৪৫ মিনিট বা এক ঘণ্টার পথ। আমি খুবই পরিশ্রান্ত অবস্থায় আমার নতুন ঠিকানায় হাজির হলাম। বাড়িওয়ালীকে বললাম, সকাল ন’টায় নাশতা করব। সকালেই ভাবতে শুরু করলাম যে কি করতে হবে। ঠিক করলাম যে প্রথমেই টমাস কুকের সদর দফতরে যাব এবং আকরাম জাকির সঙ্গে যোগাযোগ করব। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বাড়িওয়ালী মহাসমারোহে নাশতা খাওয়াল। আবার বেরুবার সময় রুটি দিয়ে বলল, মেলায় যখন যাবে অবসরে খেতে পার। টমাস কুকে গিয়ে আমার দুর্দশার কাহিনী বললাম। তারা জানাল যে, জাহাজের টিকেট নতুন করে দেয়া যাবে কিন্তু ট্রেনের টিকেট তো সব হারিয়ে গেছে তা আর পাওয়া যাবে না। আমি তাদের বললাম, এমনও তো হতে পারে যে আমার প্যাকেটটি ট্রেনেই যে কামরায় আমি উঠেছিলাম সেখানেই পড়ে যায়। তারা বলল, কোলনে তাদের দফতরকে তারা খবর দেবে যদি কেউ প্যাকেটটি ফেরত দেয়। আমি আবার স্টেশনে গিয়ে আর এক দফা খোঁজাখুঁজি করলাম। অবশেষে প্রায় আড়াইটায় আকরাম জাকির সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের পথে চললাম। আকরাম জাকির সঙ্গে সলা পরামর্শ করে ঠিক করলাম যে আরও দুই দিন আমি আমার হারানো প্যাকেটের জন্য অপেক্ষা করব। তারপর রাষ্ট্রদূতের কাছে বিষয়টি তুলে ধরব। জাকি বলল, তারা আমাকে সরাসরি করাচীতে পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে প্রক্রিয়া শুরু না করলে আমাকে অযথা ব্রাসেলসে অতিরিক্ত দিন থাকতে হবে। আমি বিকেলে আবার শিল্প মেলায় গেলাম এবং উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ালাম। ষষ্ঠ দিনে জাকির জারিজুরিতে রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি অবহিত করতে গেলাম, তিনি খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করলেনÑ কেন আমি সেদিন রাতেই তাকে ফোন করলাম না? বলে রাখা ভাল যে, ছাত্রাবস্থায় তিনি যখন ইতালিতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন তখন থেকেই তাকে চেনার সুযোগ আমার হয়। তিনি জাকিকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বললেন এবং আমাকে বললেন, আমার দ্রুত দেশে প্রত্যাবর্তন করা দরকার। তাই তিনি করাচী থেকে উপদেশের অপেক্ষা না করে আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এ জন্য যা খরচ হবে সেটা তিনিই আপাতত দেবেন। দেশে ফিরে আমি তা শোধ করলেই হবে। আমি ব্রাসেলসে পৌঁছে একদিনও দাড়ি কাটিনি। তিনি সেটা নজরে নিয়ে বললেন, ‘কি সুরত বানিয়েছ। একটু সাফ সুতরা হও। আর কাল দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে। পাকিস্তান থেকে কেউ কেউ মেলায় এসেছে। তাদের কালকে লাঞ্চে ডেকেছি।’ পরের দিন সকালেই টমাস কুক থেকে টেলিফোন আসল। তারা জানাল যে, আমার হারানো প্যাকেট পাওয়া গেছে। একজন জার্মান যাত্রী সেটা তুলে নেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, ট্রেনেই কেউ এর খোঁজ করবে। যাই হোক তিনি ব্রাসেলসের টমাস কুকের দফতরে সেটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মহা খুশির খবর, আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রদূতকে খবরটি দিলাম। দুপুরে তার বাড়িতে খেতে গেলাম। সেখানে বেগম রহমান আমাকে সান্ত¡না দিয়ে জানালেন, তিনি তার স্বামীকে বলেছেন, করাচীর নির্দেশের অপেক্ষা না করে তিনি নিজে থেকেই যেন আমাকে করাচীতে পাঠাবার ব্যবস্থা দ্রুত নেন। তার দুঃখ প্রকাশ শেষ হলে রাষ্ট্রদূত তাকে জানালেন, ‘দুঃখের আর কোন কারণ নেই, ওর হারানো সব কিছুই পাওয়া গেছে। খাবার পরেই ও টমাস কুকে গিয়ে তার কাগজপত্র সব ফেরত পাবে।’ রাষ্ট্রদূতের অন্যান্য অতিথিও কেউ কেউ আমার দুর্দশার কথা শুনেছিলেন। তাই সবাই বললেন, সেদিনের লাঞ্চটি হবে আমার জন্যই। আমার সাময়িক দুর্ভোগ এবং অসাধারণ সৌভাগ্যের জন্যই হবে উৎসব। চলবে...
×