ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাইফুজ্জামান

আবুল হাসানের সৃষ্টির জগৎ

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১১ নভেম্বর ২০১৬

আবুল হাসানের সৃষ্টির জগৎ

নিঃসঙ্গতা, বেদনাবোধ ও আত্মবিবরণী যার কবিতাকে স্বতন্ত্র ও সমুজ্জ্বল করে তুলেছে তার নাম আবুল হাসান। কবি আবুল হাসান বাংলা কবিতার আধুনিক, ভাবনার সঙ্গে ইতিহাস ঐতিহ্য-লোকজীবনের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। আবেগ, হৃদয় বৃত্তান্ত, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলমান ঘটনা, রাজনৈতিক দোলাচাল প্রেমবিরহ ও অন্তর্গত ক্ষরণের দীপ্র উপস্থিতি তার কবিতার অন্তর্গত উপাদান। বিচ্ছিন্নতা বোধ, আত্মমুগ্ধতা ও স্পর্শকাতরতা নিয়ে ষাট দশকে আবুল হাসানের আবির্ভাব। প্রাত্যহিক আত্মবিবরণী তার কবিতাকে বর্ণনাত্মক শক্তিময়তা দিয়েছে। জীবনানন্দীয় মুগ্ধতা নিয়ে প্রকৃতি প্রেমিক কবি আবুল হাসান স্বদেশ, নিঃসঙ্গ মানুষ ও মানুষের অন্তর্গত বেদনা ও মানুুষের সংবেদনশীল সত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। আত্মজৈবনিক ভাষ্য তাকে অন্তর্জগতের মোহনীয় পরিবেশ থেকে বহির্জগতের বহুমাত্রিক দৃশ্যের কাছে সমর্পণ করেছে। প্রেমবিরহ, প্রকৃতি মানুষ রহস্যময় জগৎসংসার আবুল হাসানের কবিতার প্রধান বিষয় হিসেবে বিবেচিত হলেও তিনি সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ, যুগ যন্ত্রণা, যুদ্ধোত্তর স্বদেশে মানুষের হাহাকার ও বেদনাবোধ, পাওয়া না পাওয়াকে কবিতায় ধারণ করেছেন। নিকষ আন্ধকারের মধ্যে বাস করেও আবুল হাসান আলোর উৎস ধারায় অবগাহন করেছেন। স্মৃতি, স্বদেশ, ব্যক্তিভাবনা প্রেম, নাগরিক চেতনা ঘিরে তার কবিতা আবর্তিত। আবুল হাসানের সৃষ্টি জগৎ প্রণয় বিরহ, প্রতারক সময় স্বদেশ বন্দনায় মুখর। কবির মা বাংলার সব মায়ের প্রতিনিধি হয়ে যায় অনায়াসে। বোন বাঙালীর অহঙ্কারের উত্তরাধিকার। প্রেমিকা চেনা জনপদের রহস্যময়ী বান্ধব। আবুল হাসানের কবিতায় সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিবেশের চিত্র পরিষ্ফুট। ১৯৭২-এ প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাজা যায় রাজা আসে’- স্বদেশ, প্রকৃতি ও মানুষের অন্তর্গত বোধে শাসিত। উৎসর্গপত্রে তিনি উল্লেখ করেন ‘আমার মা আমার মাতৃভূমির মতো অসহায়।’ ব্যক্তিগত অনুভূতি জারিত পঙ্ক্তিমালা আত্মপ্রত্যয়ী, সংযত ও দৃঢ়। হাহাকার, বৃক্ষ, ফুল, মমতা ভালবাসা, বেদনায় আকীর্ণ চিত্রকল্প রহস্যময় এক জগতের সন্ধান দেয়। আবুল হাসান স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারণ করেন : অবশেষে জেনেছি মানুষ একা। জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছে ভীষণ অচেনা ও একা দৃশ্যের বিপরীতে সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনো দিন (পাখি হয়ে যায় প্রাণ) গ্রাম্য দৃশ্য, স্মৃতি, হাহাকার ও নষ্টালজিয়ায় আক্তান্ত আবুল হাসানের কবিতায় জীবনের উচ্ছ্বাস, প্রেমাকুলতা গভীর উপলব্ধির প্রকাশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। পাখির মতো তার অস্থির চঞ্চল চোখ বাংলার জনপদের প্রান্ত ছুঁয়ে যায়। আবুল হাসানের কবিতায় গ্রামীণ জীবনের টুকরো ছবি, মানুষ ও নৈসর্গিক বর্ণনার বিপুল উপস্থিতি পাঠককে আকর্ষিত করে। আবুল হাসান বার বার ফিরে গেছেন প্রিয় মানুষ, পরিচিত দৃশ্য ও হৃদয়াবেগের অন্তরঙ্গ ধ্বনির কাছে। তিনি আত্মকথনে মগ্ন হয়েছেন। তার কবিসত্তা বাউল চেতনা ও বৈষ্ণবীয় দর্শনে মগ্ন। মানবিক সম্পর্ক, সমাজ ও প্রকৃতিলগ্ন হয়ে আবুল হাসান জীবনের জয়গানে মুখর থেকেছেন। মৃত্যুভাবনা, ক্লান্তি, হতাশা তার কবিতায় উঁকি দিলেও সুন্দর তার কাছে পরম আরাধ্য। প্রেমাকাক্সক্ষা তার কবিতার অন্তর্দেশ প্লাবিত করেছে। তার কবিতায় উত্তম পুরুষে বিবৃত স্মৃৃতি ঘটনা ও বিচিত্র বোধ সঞ্চারিত। বর্নি গ্রাম তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের গভীর সম্পর্কে আলোড়িত আবুল হাসানের কবিতা স্পর্শকাতরতায় থরোথরো। পাহাড়িয়া গান, হারানো পাখি সরজু দিদি আর কীর্তনের মধুর স্মৃৃতি নিয়ে আবুল হাসান সম্মুখে অগ্রসর হয়েছেন। উজ্জ্বল ছবি প্রাণবন্ত হয়ে যায় তার কবিতার জাদু স্পর্শে: কি রকম পাহাড়িয়া গানে আর হারানো পাখির প্রার্থনায় ফুরিয়ে গিয়েছে শৈশব সুরভিত বকুল বাগান ফুরিয়ে গিয়েছে সেই হাটুরে নৌকার গভীর রাত্রির চোখে চোখ ফেলা বিস্মিত বালক। ...... তাই কেন যেন হয়ে যাই আজো সেই বর্নির বাত্তড়ের বৈকালিক সূর্যাস্তের পথ। যেখানে নদীর ভরা কান্না শোনা যেত মাঝে মাঝে জনপদ বালাদের স্ফুরিত সিনানের অন্তর্লীনশব্দে মধুর মনে পড়ে সরজু দিদির কপালের লক্ষ্মী চাঁদ মনে পড়ে নরোম সুইয়ের গন্ধ লেগে থাকা চোখ। চোখের চলিত ভাষা। সারারাত হরি কীর্তনের সে কী নদীভূত বোল (পাখি হয়ে যায় এই প্রাণ) পাশ্চাত্য কবিতার বিষয় উপকরণের সঙ্গে আবুল হাসান দেশীয় উপাদান এমনভাবে একীভূত করেছেন যে তার কবিতা বক্তব্য বিষয় উপমা-উৎপ্রেক্ষায় আধুনিকতর হয়ে উঠেছে। পাঠক তার চেনা জগৎসংসার ও সীমানা থেকে নিজেকে আবিষ্কার করেন। মমতাজারিত পঙ্ক্তিমালা চেনা জনপদের এক অচেনা এলাকা চিহ্নিত করে। সৌন্দর্য কাতরতা তার প্রিয় বিষয়। আলো নিসর্গ ও নারীকে আবুল এমন এক বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছেন যেখানে শাশ্বত এক বাঙালীর জীবন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রেমাকাক্সক্ষী এক মানব হৃদয় খুুঁড়ে দেখে রহস্য। মারী, মড়ক অতিক্রম করে আবুল হাসান আনন্দকে সঙ্গী করে নিজস্ব ভাবনায় শিল্পের চারদিক উন্মোচন করেন। তার উচ্চারণ : প্ল্যাস্টিক ক্লিপের মতো সহস্র কোকিল যেই বনভূমি গেথে নেয়/সবুজ খোঁপায় ভোর বেলা-ময়ূরের পেখমের মতো খোলা রোদে বসে/ ব্লাউজের বোতাম লাগিয়ে মিসট্রেস আসে ইশকুলে আর/কয় বালকের নির্দোষ লিখিল ভরা ক্লাস রুমে এসেও সে শোনে..../তুমি ভূখ-ের মানে এই ঢাকা শহরের এক সবুজ তনয়া, নারী/তুমি বোঝ না তার তিরিশ বছর কাল কুমারী থাকার অভিশাপ?/ তিরিশ বছর কত কাদায় যৌবন ঐ কোকিলের পাষ- রোদন (মিসট্রেস ফ্রিস্কুল স্ট্রিটা) ‘যে তুমি হরণ করো’ আবুল হাসান রচিত দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ। তার নিঃসঙ্গতা, ব্যক্তিগত হাহাকার, না পাওয়ার স্বীকারোক্তির মাঝে ও পার্থিব সৌন্দর্য আর আলোকিত ভবিষ্যৎকে ধরে রাখার সামর্র্থ্য চিহ্নিত হয়ে আছে কবিতায়। স্বতত্র কণ্ঠস্বর ধারণ করে আবুল হাসান ‘কবির ভাসমান মৃত দেহ’ কিংবা ‘কালো কৃষকের গান’ বেদনা-ট্রাজিক জীবনের কথকতা বিবৃত করে স্থির হয়েছেন এমন নয়, ধ্যানী কবি মরমী সত্তার সন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। মন্ময় কবি এই কাব্যগ্রন্থে ৪০টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ১. কালো কৃষকের গান ২. উদিত দুঃখের দেশ ৩. ক্ষমা প্রদর্শন ৪. অপেক্ষায় থেকো ৫. ভ্রমণ মাত্রা ৬. অসহ্য সুন্দর ৭. একটি মহিলা আর একটি যুবতী ৮. অনুতাপ ৯. আড়ালে ও অন্তরালে ১০. এখন পারি না ১১. স্তন ১২. সেই মানবীর কণ্ঠ ১৩. পরাজিত পদাবলী ১৪. পাতকী সংলাপ ১৫. অন্যরকম সাবধানতা ১৬. ঘুমোবার আগে ১৭. তুমি ভালো আছো ১৮. চিবুক ছোব, কালিমা ছোব না ১৯. গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর ২০. আমি অনেক কষ্টে আছি ২১. করুক্ষেত্রে আলাপ ২২. কবির ভাসমান দেহ প্রভৃতি কবিতায় আবুল হাসানকে সপ্রতীভ, শুদ্ধ ও স্থিত হিসেবে আবিষ্কার করা যায়। শব্দ ব্যবহারে সফল কবি কবিতার দুরূহ দুর্বোধ্যতাকে অতিক্রম করে গভীর ও অর্থময় বক্তব্যকে কণ্ঠে ধারণ করেছেন। শব্দ ব্যবহারের নিপুণ কারিগরি দক্ষতা আয়ত্ত করে ও শব্দের অন্তর্গত অর্থ থেকে বেড়িয়ে এসে ব্যঞ্জনার দ্যুতি বিচ্ছুরণ করেছেন। আবুল হাসানের হাতে শব্দের পুনর্জন্ম ঘটে। উপলব্ধি জাত হৃদয়গ্রথিত বক্তব্য নির্মাণ কুশলতায় ঋদ্ধ। ‘যে তুমি হরণ করো’ কাব্য গ্রন্থে আবুল হাসান সঙ্গত কারণে উল্লেখ করেন’ বিপ্লবী কবি প্রেমিক ও পরাজিত মেঘদল ছাড়া পৃথিবীর সব ভুল শোষক-শাসক পারিতোষিক ভ- সমালোচক ও স্থূল সৌন্দর্য ধারকদের জন্য এই বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করছি।’ অনেক স্বপ্ন নিয়ে বাঙালী মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়। স্বাধীনতার পর সাধাারণ মানুষের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তীব্র হয়ে ওঠে। এ কাব্য গ্রন্থের অনেক কবিতা স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় আক্রান্ত। উদিত দুঃখের দেশে মানুষের নিস্তরঙ্গ জীবনের দোলাচাল, প্রণয়, বিরহ, দেশ ও সমকাল ঘিরে আবুল হাসানের কবিতা আবর্তিত হয়। ধ্যানমগ্ন কবি নিসর্গ ও মানুষের অন্তর্গত বোধের কাছে সমর্পিত। কালো কৃষক প্রতিবাদী মানুষের প্রতীক হয়ে যায়। কবি সখেদে বলেন : দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখব না আমার ভেতর (কালো কৃষকের গান) আবুল হাসান শান্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছেন। স্বাধীনতার তিলক উৎকীর্ণ বাংলায় সাধারণ মানুষের মনোযন্ত্রণা, রক্তক্ষরণকে গভীর মমতায় নিজের মধ্যে ধারণ করে তিনি উচ্চারণ করেন : লক্ষ্মী বউটিকে আমি আর কোথাও দেখিনা/হাঁটি হাঁটি শিশুটাকে কোথাও দেখিনা/কতকগুলো রাজহাঁস দেখি/নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি/ কতকগুলো মুখস্থ মানুষ দেখি/বউটিকে কোথাও দেখিনা/তবে কি বউটি কি রাজহাঁস/ তবে শিশুটি কি আজ সবুজ মাঠের সূর্য, সবুজ আকাশ/কেবল উৎসব দেখি/স্বাধীনতা দেখি/তবে কি আমার ভাই আজ স্বাধীন পতাকা?/তবে কি আমার বোন তিমিরের বেদিতে উৎসব (উচ্চারণগুলো শোকের) লক্ষ্মীমন্ত বউ, শিশু ভাইয়ের উদ্দেশ্যে আবুল হাসান যে শোক প্রকাশ করেছেন তা হৃদয়স্পর্শী। হারিয়ে যাওয়া উৎসব ও যাপিত জীবন তাকে স্মৃতি ভারাক্রান্ত করে। আধুনিক কবি যুদ্ধের বিপক্ষে। আবুল হাসান প্রত্যক্ষ করেছেন পৃথিবীর সভা সমিতি ও সংগঠন মানুষের হিংস্রতা শত্রুতা ও বিনাশের বর্বরতায় স্তব্ধ হয়ে যায়। আবুল হাসান মানুষকে তাক করা শত্রুর বন্দুকের গুলিকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য ব্যাকুল। সঙ্গত কারণে আবুল হাসানের উচ্চারণ : মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতি সংঘ আমাকে নেবে না’ (জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন) আবুল হাসানের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথক পালক’ ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত। কাব্য গ্রন্থটি সুরাইয়া খানমকে উৎসর্গ করা। শেষ প্রচ্ছদে উল্লেখ ছিল ‘বাংলা কবিতার অতিশায় উর্বর এক ভূমি খ- কর্ষণ করে চলেছেন আবুল হাসান। যখন তিনি এই স্ব্যগতোক্তি করেন আমার আত্মার রুগ্নতাই একমাত্র সৌন্দর্য তখন মনে হয় সমস্ত পৃথিবী ভরে নেমেছে এক ক্ষীণ ম্লান মরা জোৎস্নার ঢল-যেখানে সম্পূর্ণ নগ্ন দেহে নতজানুুুু হয়ে অবগাহন করেছেন পৃথিবীর এক শীর্ণকায় কবি, যার অমল হৃৎপি- থেকে ক্ষরিত হচ্ছে ফোটা ফোটা সৌন্দর্যানুভূতি, টৈটম্বুর উপচে পড়ছে প্রসারিত করতল বেয়ে জানুসন্ধিতেÑকবি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন ঋতুমতী বসুন্ধরার বুকে, আঃ কি সুন্দর কী মধুর এই পীষুষ ধারা।... পৃথক পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে আবুল হাসান চড়ুইয়ের মতো মুখ ঠোকরান শীতল ও স্বচ্ছ আয়নাতে।’ কবি আবুল হাসান এই কাব্য গ্রন্থভুক্ত কবিতায় মানুষের অন্তর্গত বোধ অতিক্রম করে দেশ কাল ও সমাজ রূপান্তরের ভয়াবহ চিত্রে সংলগ্ন থেকেছেন। আবুল হাসান সমাজের অভ্যন্তরের ভাঙ্গাগড়া উত্থান-পতনকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ক্লেদাক্ত জীবনকে পেছনে ফেলে সুন্দরের দিকে তার চোখ প্রসারিত। আবুল হাসান শান্তিঅšে¦ষী। সপ্রতীভ জীবন, আলো ছায়া ও মেঘলা দুপুর ক্লান্ত মানুষ তার ছায়া সঙ্গী। দার্শনিক চোখে কবি লোকালয় বনভূমির দিকে ফিরে তাকিয়েছেন। আবুল হাসানের তিনটি কাব্যগ্রন্থ বৈশিষ্ট্য বিচারে যে সব প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ১. রাজা যায় রাজা আসে-তে তিনি লালিত্যময় পদ্যরীতি অনুস্মরণ করেছেন। শব্দের সঙ্গে শব্দের যোজনা তৈরি করে কবিতাকে কতখানি আকর্ষণীয় করা যায় তা নিয়ে ভেবেছেন। ২. যে তুমি হরণ করো-তে জাদুময় লিরিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে। প্রেমবিরহ, দেশ, সমাজ তার ক্যানভাসে বন্দী হয়েছে গভীর মমতা ও সযতেœ। ৩. পৃথক পালঙ্ক’তে আবুল হাসান পরিণত কবির চোখে সামঞ্জস্যপূর্ণ পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের স্বাদ আস্বাদন করে দায়বদ্ধতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। আবুল হাসান প্রেমিক কবি। তার দ্রোহ ভালবাসার অতল তল থেকে উৎসারিত। কবি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। এই প্রস্তুতি পরিকল্পিত।স্থিত কবি তুলনামূলক ভাবনাকে একসঙ্গে গ্রথিত করে কত অনায়াসে তীব্র যন্ত্রণা ও দুঃখে বলতে পারেন ‘যাই’। যাই, এখন তাদের শরীরে শস্যের আভা ঝরে পড়ছে যাই নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে তার তীব্রতায় তরুণ দুঃখের কাছে ফিরে যাই, যাই মৃত্যু আর মৃত্যু আর মৃত্যুর আঁধারে যাই বিবর্ণ ঘাসের ঘরে ফিরে যাই, যাই যেখানে বোনের লাশ, আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে নিতে হবে আমি যাই ........... রক্তের ঝর্ণায় ভেসে ভূমধ্য শস্যের বৃষ্টি হয়ে গেছে কারা ফের মেঘের সম্মুখে সাদা সোনালি রোদ্দুর। যাই আমার পকেটে আছে তাহাদের নীল চিঠি নীল টেলিগ্রাম যাই শম্যের ভিতরে রোদ-রোদে যাই রোদ্দুরের মধ্যে চলে যাই। কবি তারিক সুজাত সম্পাদিত আবুল হাসানের কাব্য নাটক ‘ওরা কয়েকজন’ ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। আবুল হাসান ভালবাসার কাছে বিশ্বস্ত এক কবি। শান্তি প্রত্যাশী তার কাব্য নাটকে যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। কাব্য নাটকের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে আবুল হাসানের স্বদেশ প্রেম আর মানুষে মানুষে সৎ প্রতিবেশী ও একতাবদ্ধতার প্রণোদনা : কবিতা : নারী : ভালোবাসা মানে এই পরস্পর শান্তি আর একতাবদ্ধতা ভালোবাসা মানেই তো একে অপরের প্রতি সুবিশ্বাসী হওয়া ভালোবাসা মানেই তো হৃদয়ের ইতিহাস থেকে সব ঐতিহ্য ধারণ করা, ভালোবাসা মানেই তো একতার উর্ধে সুুুসংহত হওয়া। ভালোবাসা মানেই তো ক্ষণবিভ্রমের শেষ। এই আলোয় কোন আবিশ্বাসী উত্তেজনা নেই বিভ্রান্তিও নেই। প্রেমিক : আর নেই কারো চিত্তবিকারের পরিণতি প্রকৃত আলোর কোন ক্ষয় নেই। আলো অনিঃশেষ আলো শান্তিকামী। আবুল হাসান স্মৃতি, বেদনা, স্বপ্ন, গ্রাম পাহাড়, রৌদ্র ছায়ার সঙ্গে একাত্ম থেকেছেন। তার প্রেমিকসত্তা ক্রমশ : উজ্জ্বল একটি জনপদে প্রবেশ করেছে। তিনি জীবনের জয়গানে মুখর। জীবন ও ভালবাসা দুই সহযাত্রী তার আজন্ম সহচর। পাওয়া, না পাওয়ার বেদনার দীর্ণ কবি। আশা-নিরাশার দোলাচালে হাহাকারে নিমজ্জিত হয়ে ভেসে যায়নি মাস্তুল। অন্ধকার সমাজে আবুল হাসানের কবিতা আশার আলোক বর্তিকা জ্বালিয়ে রাখে। নিঃসঙ্গ চেতনা, স্মৃতি কাতরতা আত্মগত অভিব্যক্তির সফল রূপকার আবুল হাসান বাঙালী পাঠকের মনে স্থায়ী আসন অধিকার করে আছেন। আবুল হাসানের জন্মগ্রাম বর্ণিঘিরে তার নষ্টলজিক স্মৃতির সঙ্গে আমরা গ্রথিত হই। গ্রাম থেকে ছুট হয়ে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের শেকড় বিচ্ছিন হওয়ার মর্ম বেদনায় আমাদের একাত্ম হতে হয়। আমাদের জীবনেরও একজন ফাতিমা ফুপু এসে কড়া নাড়ে। ‘কষ্টে আছি বুঝলে যুথী।’ এমন উচ্চারণে কৈশোর প্রেম আন্দোলিত করে স্মৃতি সত্তাকে। আবুল হাসানের কবিতা পাঠে জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই আমরাও। আবুল হাসান এক জীবন বাদী কবির নাম। তার কবিতা প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করে স্বপ্ন ও ভালোবাসায়। saifyyuaman.bnm@gmail. Com
×