ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া ইসলাম নিপা

শিল্পকলা ॥ ইম্প্রেশনিস্ট ক্লদ মোনে

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১১ নভেম্বর ২০১৬

শিল্পকলা ॥ ইম্প্রেশনিস্ট ক্লদ মোনে

ক্লদ মোনে ইম্প্রেশনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ। বলিষ্ঠ রেখা আর উজ্জ্বল রঙের উৎসবের এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। নানা রং, নানা মুড, নানা আলো ছায়াময়তায়, নানা কোণ থেকে, পুকুরের নানা পাড় থেকে মোনে তাঁর একান্ত প্রিয় লিলি ফুলের বাগানটির পুনর্নির্মাণ করেছেন বার বার আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ক্যানভাস জুড়ে জেগে থেকেছে কুহক সবুজ আর মায়াবী নীল। তাঁর ছবি জীবনের নানা ব্যস্ততা আর সমস্যার ঢেউ পেরোতে থাকা মানুষের চোখে বুলিয়ে দেয় শান্তির চন্দন প্রলেপ। প্রকৃত অর্থে যে শিল্প আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিল্পধারা আধুনিক যুগে পদার্পণ করে সেই সোপান হলো ইম্প্রেশনিজম বা রূপবাদ। পূর্ববর্তী নিউক্লাসিক্যাল যুগের ধ্রুপদী শিল্প রোমান্টিসিজমের আবেগ ঘন অনুভূতি এবং রিয়েলিজমের নিরেট বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আত্মপ্রকাশ ঘটায় এ আন্দোলন। ১৮৭৪ সালে ‘স্যালোর’ নিয়মিত প্রদর্শনীতে কতিপয় বাদ পরা বিদ্রোহী শিল্পীরা ‘স্যালো দি রিফিউজে’ নামে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। আর সেখানেই ইম্প্রেশনিজম শব্দটি যে অভিধান থেকে গৃহীত হয় সেই সম্পাদকীয় শিল্পী ক্লদ মোনের ‘ইম্প্রেশন সানরাইজ’ শিল্পকর্মটি স্থান পায়। যার সূত্র ধরেই শিল্প সমালোচক লুইস লেরয় তার ‘ক্যারিভ্যারি’ পত্রিকায় এই প্রদর্শনীর কাজের ধারাকে ইম্প্রেশনিজম বলে অভিহিত করেছেন। গোটা ইম্প্রেশনিজমের কেন্দ্র বিন্দুতে ছিল মোনের কাজ। ক্লদ মোনে সম্পর্কে স্বার্থক এ উপমা প্রদান করেন শিল্পকলাবিদ নীনা কালিতিনা। তাঁর প্রতিটি শিল্পই হলো ইম্প্রেশনিজমের আয়না। সমসাময়িক সময়ে বিজ্ঞানী শেভরিল রং ও আলোর তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ফলে সূর্যের সাতটি রঙেই সাজাতে চেয়েছেন শিল্পী তাঁর ক্যানভাস। আলো ছায়ার পাশাপাশি সময়, পরিবেশ, বিশেষ মুহূর্ত আবেগ গতি ও ওজনের প্রতি জোর দিলেন শিল্পীরা, মূলত ক্যামেরার সঙ্গে প্রতিযোগিতার রক্ষার্থেই। ছায়া মানেই কালো বা ছাই রং নয়, প্রতিটি বস্তুর ছায়া ভিন্ন ভিন্ন রঙের এ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। বৈজ্ঞানিক মানসের ফলশ্রুতি ছিল শিল্পী মোনের চিত্র। আলোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বস্তুর গড়ন ও পরিবেশের যে আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন এই শিল্পী তাঁর প্রতিটি কাজে। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে চিত্র রচনায় তুলির বলিষ্ঠ টান খুঁটিনাটি এড়িয়ে ইম্প্যাস্টোর ব্যবহারে অর্থাৎ স্পেচুলা দিয়ে ভারি রং প্রয়োগের মাধ্যমে মোটামুটি ভাব প্রকাশের চেষ্টা করত ফলে শিল্পকর্মগুলো দেখে মনে হতো তেল রঙের স্কেচ। রং প্রয়োগে অপটিক্যাল মিক্সিং পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ চিত্রে বেগুনী রঙের প্রয়োজনে তাতে লাল বেগুনী ও নীল রঙের পাশাপাশি উপস্থাপন দেখান। শিল্পী রং এবং আলোকেই প্রধান উপজীব্য করেছিলেন। কারণ ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা ভাবত রংই আলো। এজন্যই সরাসরি টিউব থেকে রং প্রয়োগ করত। শিল্পকর্ম উজ্জ্বল দেখানোর প্রয়াসে তারা হাইলাইটের প্রয়োজনে সরাসরি সাদা রং প্রলেপনের নজির উপস্থাপন করেছেন। সমসাময়িক সময়ে জাপানিজ শিল্পকর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে আর যার রেশ ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের কাজেও বয়ে গেছে। তাই তো মোনের বেশকিছু শিল্প নির্মাণে এই প্রভাব লক্ষণীয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিশাল স্পেস ছেড়ে দেয়া এবং ফ্ল্যাট করে আঁকার পাশাপাশি জাপানিজ ঐতিহ্যবাহী পাখা কিমোনো পোশাক প্রভৃতি দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর স্ত্রীকে ‘ম্যাডাম মোনে ইন এ জাপানিজ কিমোনো’ চিত্রটিতে। মোনের অধিকাংশ সৃষ্টিই সিরিজ শিল্প। শিরোনামী শিল্প ‘ইম্প্রেশন সানরাইজ’ যেখানে তিনি লা হার্বে সমুদ্র বন্দরের বুকে ভেসে থাকা জাহাজ আকাশ ও সমুদ্রের মিতালী ঘটিয়েছেন। সমুদ্রের জলে প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা, আকাশ, জাহাজ, নৌকা ও সূর্যের, ভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন ঘোলাটে পরিবেশে লালচে আভা বিলিয়ে দিচ্ছে সূর্য তার চারদিকে। নিখুঁত মসৃণ পরিপাটি রং প্রলেপন এখানে অনুপস্থিত, আত্মপ্রকাশ ঘটে টিউব থেকে নেয়া রঙের প্রশস্ত ব্রাশ স্ট্রোক। এ চিত্রে বিষয়বস্তু বাদ দিলে সম্পূর্ণটাই বিমূর্ত রূপ লাভ করে। মোনের সিরিজ কাজের মধ্যে অসাধারণ সৃষ্টি হলো ‘হেস্টেকস’ এর চিত্রগুলো। বিষয়বস্তুকে অপরিবর্তিত রেখে সময় এবং আলোর পরিবর্তনের সঙ্গে বস্তুর রঙের অলৌকিক এবং মোহনীয় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন আমেজ তৈরিতে সফল হয়েছেন শিল্পী মোনে। ১৫টি ছবিতে কোথাও রৌদ্র ঝলমল আকাশের নিচে খড়ের গাদা কোথাও গোধূলীর রঙে আবৃত খড়ের গাদা। কখনও বরফে আচ্ছাদিত মাঠ ও খড়ের গাদা আর কখনোবা লালচে নীলাভ বা সবুজে সতেজ সজীব ঘাসের ওপর হলুদ কিংবা লাইলাল বর্ণের উদ্ভাসিত খড়ের গাদা। অত্যন্ত বিচিত্র এবং দক্ষ নিপুণতার বর্ণচ্ছটায় বহুমাত্রিক দীপ্তি উপস্থাপনে সিদ্ধহস্তের প্রমাণ দিয়েছেন শিল্পী ক্লদ মোনে তাঁর এই চিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে। রউয়েন ক্যাথিড্রাল নিয়ে ২৬টি চিত্রকর্ম সাজিয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে। ক্যাথিড্রালের সম্মুখ সঙ্গীত রচনায় রঙের তরঙ্গায়িত স্পন্দিত রূপ উপস্থাপন করেছেন। সকালের সাদার হারমনি তো দিনান্তের নীলের হারমনি, রৌদ্রজ্জ্বোল ক্যাথিড্রাল ধূসর গোলাপী রং ধারণ করেছে আবার কখনও তাতে শ্বেত শুভ্র পাথর বা পোড়ামাটির আমেজ অনুভব করিয়েছেন। তবে সবটা জুড়েই রং প্রলেপনের দরুন গির্জার পবিত্র ঐশ্বরিক ধোয়াটে ভাব অক্ষুণœœ ছিল। মোনের জীবনের শেষ বিখ্যাত ও বহুল প্রশংসিত সিরিজ কাজ হল ‘ওয়াটার লিলিজ’। এবার তাঁর দৃষ্টি বাগানের পাশের পুকুরে ফুটে থাকা শাপলা ফুলের সৌন্দর্যে। পুকুর জলের উপরিস্তরের সঙ্গে জলের গভীরের আলোকেও তুলে এনেছেন। ¯িœগ্ধ সাদা শাপলা সবুজ পাতা এবং পুকুরের পাড়ের ঝোপ গাছপালার ছায়া জলের ময়ূরকণ্ঠী রং ধারণে সহায়তা করেছে। শাপলা কখনও গোলাপী লাল আবার কমলাটে হলুদ বর্ণেও সেজেছে। থোকায় থোকায় রং জলের ওপর খেলা করছে। ঝিলমিল রঙে চঞ্চলা শাপলা ভেসে বেড়াচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের নীল জলে সাদা শাপলা কালচে সবুজ পাতার বেষ্টনীতে উঁকি দিচ্ছে উর্ধপানে। শাপলার ডগার সর্পিল রেখা জল অভ্যন্তরে কালচে ভাবমূর্তি বহন করছে। অগোছালো রঙের ব্রাশ স্ট্রোকের শাপলা মুগ্ধতার জগতে মনকে সংবরণ করে নিয়ে যায়। ক্লদ মোনের ‘ওমেন ইন এ গার্ডেন’ শীর্ষক ছবিগুলোতে মূলত শুভ্র ফ্রক পরিহিত রমণীদের উপস্থাপন ঘটিয়েছেন রৌদ্রজ্জ্বোল ঝলমলে দুপুর পরিবেশে। আলোকছটা ফ্রকের উজ্জ্বলতা আরও বাড়িয়ে দেয়। রোদ হস্ত মুক্তি প্রয়াসে ছাতার ব্যবহার লক্ষণীয় সেই ফুলেল মুখরিত বাগানের পরিবেশে। আকারে দীর্ঘ না হলেও ছবিগুলো বিশাল পরিবেশের বিস্তৃত উপস্থাপন বলে মনে হয়। ‘দ্য পপলার’ এ নীল সবুজ আকাশের বিপরীতে চকিত প্রকাশিত দন্ডায়মান পপলার গাছের সারি। নদীতে ছায়া ফেলেছে বাতাসে দোদুল্যমান শীর্ষভাগ স্পষ্টতই শিল্পীর মনকে দোলাতে সক্ষম হয়েছে। তাইতো তিনি পপলারকে গাছ নয়, উজ্জ্বল রঙের বিনুনি বেষ্টিত কোন ছন্দের মালায় গেঁথেছেন। সারা সবুজ মাঠে কখনও লাল লাল রঙের ঝোপের দ্বারা পপি ফুলের সৌন্দর্য প্রকাশ করেছেন। মোনে তাঁর সকল চিত্রে রঙের জাল দিয়ে আলোকে ধরতে চেয়েছেন। আলোকে অবগাহনের প্রয়াসেই তাঁর তুলি তেপান্তরের পথ পাড়ি দিতেও ক্লান্তির সম্মুখীন হয়নি। ক্লদ মোনে নিজেই বলেছেন নিরন্তর দেখা আর ক্রমাগত ভাবনার মধ্য দিয়েই তৈরি হয় দৃশ্যানুভূতি। মনের গহীনে তৈরি হওয়া সেই দৃশ্যকেই আঁকতে চেয়েছেন পালাবদলের এই নিপুণ শিল্পী। শিল্পী ক্লদ মোনে (জন্ম ১৪ নবেম্বর ১৮৪০, মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ১৯২৬) ও তাঁর শিল্পকর্ম ‘ওমেন ইন এ গার্ডেন’
×