ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মনের আলোয় পথচলা

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১১ নভেম্বর ২০১৬

মনের আলোয় পথচলা

আত্ম-প্রত্যয়, নিজ উদ্যোগ, উৎসাহ ও সহযোগিতা পেলে যে কোন মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যতা এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তাই প্রমাণ করেছেন কয়েকজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী নিজ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের সংগ্রামী জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরেছেন- দিনেশ মাহাতো তাসলিমা সুলতানা মিতু, নাহিয়ান বুশরা, রতœা বিশ্বাস, জয়নুব খাতুন, সুরাইয়া আহমেদ শরীফা, ঝুমুর আক্তার, হাসিনা খাতুন, রাজিয়া সুলতানা, লিপি আক্তার, শাকিলা আক্তার মিতু ও পারমিতা যেতরা এরা সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এদের প্রত্যেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত। প্রতিবন্ধকতা এদের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তারা এখন প্রেরণার উৎস। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। প্রতিকূলতার যাবতীয় অন্তরায় অতিক্রম করে পেয়েছে কাক্সিক্ষত সাফল্য। তাই তারা অদম্য। তাদের চোখে আলো নেই কিন্তু হৃদয় ভরে আছে আলোয় আলোয়। যদিও এরা দুষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী কিন্তু তাদের সাফল্য স্বাভাবিক অন্য আর দশটি মেয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন থাকে যে কোন শিক্ষার্থীরই। দু’একজনের ছাড়া বাকি সবার জন্মই গ্রামে। সেই গ্রাম থেকে শিক্ষার একের পর এক ধাপ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা হিমালয় জয়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য তাদের হয়নি। মায়ের ভাষার বর্ণমালা বা ইংরেজী অক্ষর কিছুই চোখে দেখেনি তারা। তাদের কেউ জন্ম থেকে কেউ জন্মের পর থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সাফল্যের পথে আলোহীন চোখ বা দরিদ্রতা কোন কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি এদের ক্ষেত্রে। তাদের অদম্য ইচ্ছায়, জীবনে একটা কিছু হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তারা এগিয়ে চলেছেন। তাইতো তারা আজ সাফল্যের শিখরে তুলে ধরতে পেরেছেন নিজেকে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের পদচারণা। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করেছেন সবাই জিপিএ ৪ পয়েন্টের নিচে কেউ নেই এদের মধ্যে দুই তিন জনের দুটোতেই জিপিও ফাইভ রয়েছে। অন্য অনেকের মতো তাদের পেছনে ছিল না গৃহশিক্ষকের লম্বা লাইন। তারপরও তাদের এমন সাফল্য প্রশংসার দাবি রাখে। কতটা কঠিন ছিল তাদের লড়াই ভাবলেই অবাক হবেন যে কোন মানুষই। তারা শুধু পড়ালেখাতেই ভাল এমনটা নয় সাংস্কৃতিক কর্মকা- যেমন গান কবিতাও তারা পারেন। এদের দু-একজন খুব ভাল গানও গাইতে পারে। এমনকি স্কুল লেভেলে অনেকে পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছেন গান গেয়ে। এদের মধ্যে মিতু, শরীফা, রাজিয়া, শাকিলা ও বুশরার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়। তাসলিমা সুলতানা মিতু যেমনটা জানান জন্মের ছয় মাস পর থেকে সে দৃষ্টি হারান। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানায়। তারা চার বোন এক ভাই সে সবার বড়। ২০১০ সালে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট থেকে জিপিএ ৪.৫৬ নিয়ে এসএসসি পাস করেন। এবং ২০১২ সালে সরকারী বদরুননেসা কলেজ থেকে জিপিএ ৪.৯০ নিয়ে এইচএসসি পাস করেন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইইআর বিষয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে তার প্রথম শ্রেণী রয়েছে। তার স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়া। স্কুল পর্যায়ে সে নিয়মিত গান করত তবে এখন গান তেমন না করলেও কবিতা আবৃত্তির প্রতি ঝোক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেওয়া ’অন্ধবৃত্তি’ নামে যে বৃত্তি তাদের দেওয়া হয় তার নামকরণ নিয়ে মিতুর রয়েছে জোরালো আপত্তি। তিনি বলেন, ‘আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি হতে পারি দৃষ্টিহীন কিন্তু অন্ধ তো নয়। নিজে রান্না করে খাই হলে, মোবাইল ল্যাপটপ, কম্পিউটার চালাই, ফেসবুক চালাই। তারপরেও কি আমরা অন্ধ?’ আমি নিজেও তার কথার সঙ্গে একমত পোষণ করি। সুরাইয়া আহমেদ শরীফা। পড়ে ইসলামিক স্টাডিজ এ্যান্ড হিস্ট্রি বিষয়ে ২য় বর্ষে। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানায়। দুই ভাই এক বোন। মিতু এবং তার স্কুল কলেজ একই রেজাল্টও প্রায় কাছাকাছি। বন্ধু ও বান্ধবীদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পান জানতে চাইলে তিনি জানান- সবাই সহযোগিতা করে, তবে মিলি ও শামীমা নামের দুই বান্ধবী যাদের কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সহযোগিতা পেয়ে থাকি। রাজিয়া সুলতান তার বাড়ি শরীয়তপুর। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে তৃতীয়। নাহিয়ান বুশরা জন্ম ঢাকায় পড়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ২য় বর্ষে। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সে ভাল গানও গায়। ছায়ানটের নজরুল বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। এক বছর বয়সে মেনিন জাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে সে দৃষ্টিশক্তি হারায়। ছোটবেলায় তার মনে হতো সবাই দেখতে পাচ্ছে আমি পাচ্ছি না, তাই মনে কিছুটা কষ্ট পেতেন কিন্তু এখন তার এ নিয়ে তেমন কোন কষ্ট নেই। অন্যদের মতো তারও ইচ্ছে বিসিএস ক্যাডার হওয়া ও পাশাপাশি একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা। এমনকি দেশের বাইরে যাবারও ইচ্ছে রয়েছে তার। শাকিলা আক্তার ইতি পড়েন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রথম বর্ষে। তার জন্ম বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর থানায় হলেও বেড়ে ওটা ও পড়াশোনা ঢাকায়। তিনি সালনা এন এম উচ্চ বিদ্যালয়, গাজীপুর থেকে মাধ্যমিক এবং সরকারী বদরুননিসা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন । তবে সে জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।তারা দুই ভাই তিন বোন। রতœা বিশ্বাস পড়েন আইইআর ৩য় বর্ষে , বাড়ি গোপাল গঞ্জ। জয়নুব খাতুন পড়েন ইসলামিক হিস্ট্রি এ্যান্ড কালচার বিভাগে ৪র্থ বর্ষে , বাড়ি রংপুর। ঝুমুর আক্তার পড়েন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ২য় বর্ষে, বাড়ি খুলনা। হাসিনা খাতুন পড়েন আইইআর ২য় বর্ষে, বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। লিপি আক্তার পড়েন ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ৩য় বর্ষে, বাড়ি লালমনিরহাট জেলায়। পারমিতা যেতরা পড়েন ইসলামিক স্ট্যাডিজ ম্যান্ড কালচার বিষয়ে ১ম বর্ষে। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গানের চচ্র্াও করে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইয়ার বা সেমিস্টারের রেজাল্টগুলোতেও তারা ভাল অবস্থানেই রয়েছেন। তাদের রেজাল্ট প্রথম শ্রেণীর নিচে কারও রেজাল্ট নেই। শুধু প্রতিবন্ধী নারীরা নয় সমগ্র নারী জাতি আজ শিক্ষা, রাজনীতি ও প্রশাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন রেবর্ড সৃষ্টি করে চলেছেন। অতীতের যুদ্ধবিগ্রহ থেকে মহাকাশ জয় সবখানেই রয়েছে নারীর পদচিহ্ন। মনের জোর ও কিছু করার জেদ বা প্রবল বাসনা থেকেই মিতু, বুশরা, রাজিয়া ও শাকিলাদের আজকের এ সাফল্য। তাদের প্ররিবারের ভূমিকাও কোন অংশেই কম নয়। এদেরকে দৃষ্টান্ত মনে করে পেছনে পড়া সাধারণ মেয়েরাও সাহস এবং উৎসাহ পাবে। তারা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাবেই এতে কোন সন্দেহ নেই। সম্ভাবনাময় জীবন তাদের দ¦ারপ্রান্তে। আমরা তাদের সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি। [email protected]
×