ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আরও একজনের মৃত্যু

সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের পাশের দু’গ্রামের সাঁওতালরা অবরুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ নভেম্বর ২০১৬

সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের পাশের দু’গ্রামের সাঁওতালরা অবরুদ্ধ

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা, ১০ নবেম্বর ॥ জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষের ঘটনায় বৃহস্পতিবার আরও এক সাঁওতাল মারা গেছেন। তিনি সাপমারা ইউনিয়নের সিনটাজুরি গ্রামের বাসিন্দা। তার নাম রোমেশ সরেন (৪০)। এ নিয়ে ওই সংঘর্ষে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের তিনজন মারা গেলেন। এদিকে, রংপুর চিনিকলের আওতাধীন গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জায়গায় সাঁওতাল বসতি স্থাপনকারীদের উচ্ছেদ করার পর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে। কর্ম ও খাদ্য সঙ্কটের কারণে তারা এখন দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। এছাড়া সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের পার্শ্ববর্তী জয়পুর ও মাদারপুর গ্রাম দুটির সাঁওতালরা এখন এক রকম অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। তারা গ্রামের বাইরে হাট-বাজারে যেতে পারছে না। তাদের ছেলেমেয়েরা ভয়ে-আতঙ্কে স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না। পার্শ্ববর্তী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা সাঁওতাল পরিবারের লোকজনদের যেখানে পাচ্ছে সেখানেই মারপিট করছে বলে তারা অভিযোগ করেছে। একই এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কলেজছাত্র বলেন, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজন সাইকেল, টাকা-পয়সা নিয়ে রাস্তায় বের হলেই কেড়ে নেয়া হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী কাটাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকের লোকজন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনকে হাট-বাজার করতে দিচ্ছে না। এদিকে, বৃহস্পতিবার দুপুরে সিপিবি ও বাসদের ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল খালেকুজ্জামান ও আমিনুল ফরিদের নেতৃত্বে সাঁওতাল অধ্যুষিত স্থানীয় দুর্বৃত্তদের লুটপাটে ক্ষতিগ্রস্ত মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম দুটি পরিদর্শন করে। পরে তারা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালরা এখন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। তাদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে তারা সরকারের জরুরী পদক্ষেপের দাবি জানান। সেই সঙ্গে ওই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান তারা। তারা বলেন, কর্তৃপক্ষ হামলার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। অন্যদিকে, ঘটনার নেপথ্য কাহিনী নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এলাকাবাসী ও মিলের একটি সূত্র জানায়, কর্তৃপক্ষ ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ১ হাজার ৮৪২ একর জমি রংপুর চিনিকলের আওতায় অধিগ্রহণ করা হয়। তখন থেকে এসব জমিতে উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ওই সব জমিতে মিল কর্তৃপক্ষ আখ চাষ না করে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর কাছে লিজ প্রদান করে। তারা লিজ নেয়ার পর ওই সব জমিতে তামাক, ধান, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতে থাকে। এছাড়া এসব জমিতে অন্তত ১২টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে প্রভাবশালীরা। এদিকে, মিলের জমিতে আখ চাষ না হওয়ায় দুই বছর আগে বাপ-দাদার জমি ফেরত দেয়ার দাবি তুলে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলনে নামানো হয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনকে। মাদারপুর গ্রামের সাঁওতাল পরিবারের ক্ষতিগ্রস্ত কাইমা মুরমু (৪৫), নিমুনি টুডু (৪০), তেরেজা মুরমু (৫৫), শ্যামল (৪০) ও সুভাষ (৪৫) বলেন, আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ১ জুলাই প্রায় ১০০ একর জমি দখলে নিয়ে আদিবাসীরা ইক্ষু খামারের জমিতে ঘর নির্মাণ করেন। তাদের এ কাজে সহযোগিতা করেন সাপমারা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদ বুলবুল। তিনি ভোটের আগে সাঁওতালদের বাপ-দাদার জমি উদ্ধারের কথা বলে ভূমি উদ্ধার কমিটির সভাপতি হয়ে তাদের সমর্থন নেন। মাদারপুর গ্রামের তরণ মুরমু (৪৫) ও মিকাই মুরমু (৪৮) সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, জমি উদ্ধার সংহতি কমিটির সভাপতি শাকিল আহম্মেদ বুলবুল চিনিকলের জমি দখলের জন্য সাঁওতালদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন। এজন্য চাঁদা হিসেবে সাঁওতালদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থও নেয়া হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর শাকিল আহম্মেদ বুলবুল সাঁওতালদের সঙ্গে বেইমানী করে তাদের উচ্ছেদের ব্যাপারে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করতে থাকেন। তবে এ ব্যাপারে সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আহম্মেদ বুলবুল তার বিরুদ্ধে সাঁওতালদের ঢালাও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আইনী প্রক্রিয়ায় অবৈধ দখলদাররা উচ্ছেদ হয়েছে। এ ব্যাপারে তার করণীয় কিছু ছিল না। এদিকে, তাদের মধ্যে উদ্বেগ-সংঘর্ষের ঘটনার পর তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করার সময় যে হামলা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে এরপর থেকে সাঁওতাল পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় বিমল কিসকু (৪০), চরন (৫০), দ্বিজেন টুডু (৩৫), মাজিয়া হেমব্রমসহ (৫০) সাঁওতাল সম্প্রদায়ের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনায় শ্যামল সরেন কিসকু ও মঙ্গল টুডু (৫০) নামে দুজন নিহত হয়েছে বলে পুলিশ স্বীকার করেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আব্দুল হান্নান জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উচ্ছেদকৃত জায়গায় মিল কর্তৃপক্ষ কংক্রিটের খুঁটি বসিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমানা ঘেরাও করছে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনের অভিযোগ, মিল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির নির্দেশে নির্মমভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। উপজেলার সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লীর বাসিন্দা মুগলু টুডু জানান, যৌথবাহিনীর অভিযানের পর তাদের সম্প্রদায়ের বেশকিছু লোক এলাকা ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে চলে যান। কিন্তু তারপরও স্থানীয় লোকজন তাদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে গরু-ছাগল লুটপাট করে এবং ভয়ভীতি দেখায়। এদিকে বৃহস্পতিবার মারা যাওয়া রোমেশ সরেনের পরিবার দাবি করেছে, রবিবার পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষে তিনি আহত হয়েছিলেন। গ্রেফতারের ভয়ে তিনি গোপনে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। তবে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত সরকার বলেন, রোমেশের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সংঘর্ষে তিনি মারা যাননি।
×