ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

পরীক্ষা দেয়নি ৪ লাখ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১১ নভেম্বর ২০১৬

পরীক্ষা দেয়নি ৪ লাখ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রশ্ন ফাঁসের সংকট ও নকলমুক্ত পরিবেশের মধ্য দিয়েই দেশজুড়ে চলছে এবারের অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী বা জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের কম সংখ্যা সকলের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু কমছে না ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেও প্রতিদিনই পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত থাকছে হাজার হাজার পরীক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নয়টি পরীক্ষায় বহিষ্কার হয়েছে মাত্র ১৬১। কিন্তু ফরম পূরণ করেও কেন্দ্রে আসেনি তিন লাখ ৮২ হাজার ৩৭৯ পরীক্ষার্থী। অর্থাৎ প্রতিটি পরীক্ষাতেই ঝরে পড়ছে ৪২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। এদিকে নকল বন্ধে বহিষ্কারের সংখ্যা কমলেও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অব্যাহত ঝরে পড়ার বিশাল সংখ্যায় উদ্বিগ্ন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার আগের তুলনায় কমছে একথা সত্য কিন্তু কোনভাবেই কমানো যাচ্ছে না হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এই সংখ্যা এখনও আছে উদ্বেগজনক পর্যায়েই। বিশেষজ্ঞরা ঝরে পড়া ও হলে অনুপস্থিত থাকার কারণ চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে এ বছর জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য নিবন্ধন করে ২৪ লাখ ১২ হাজার ৭৭৫ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে আগের বছরের অকৃতকার্য এক লাখ ছয় হাজার ৫৫০ জন শিক্ষার্থীও রয়েছে। সেই হিসাবে ২০১৩ সালের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে ২৩ লাখ ছয় হাজার ২২৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ২০১৩ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২৯ লাখ ৫০ হাজার ১৯৩ জন শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীই এ বছর জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। এসব শিক্ষার্থী এবং ২০১৩ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনীতে অংশ নেয়া পরীক্ষার্থীর তুলনামূলক চিত্রেই দেখা যাচ্ছে- বিগত তিন বছরে বিদ্যালয় থেকে হারিয়ে গেছে ছয় লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৮ জন শিক্ষার্থী। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাস করলেও ছয় লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৮ জন শিশু এবারের জেএসসি বা জেডিসিতে নেই। আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে অষ্টম শ্রেণীর সমপনীর আগেই তারা ঝরে পড়েছে। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ২০১৩ সালে মোট ২৯ লাখ ৫০ হাজার ১৯৩ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৪০৬ জন। এর বাইরে ইংরেজী ভার্সনে অংশ নেয় ছয় হাজার ৪৫৭ জন। সবার জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে পঞ্চম শ্রেণী শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০৯ সাল থেকে সমন্বিত এই সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়। আর ইবতেদায়ীতে এ পরীক্ষা শুরু হয় ২০১০ সালে। জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। এত গেল পরীক্ষা শুরুর আগের কথা। পরীক্ষা শুরুর পর দেখা গেল ঝরেপড়ার আরেক চিত্র। নকলমুক্ত পরিবেশে চলছে এবারের পরীক্ষাও। এবারও অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কম। এ বিষয়টি সকলের মাঝে আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু কমছে না ফরম পূরণ করেও পরীক্ষার হলে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের ৮টি সাধারণ ও একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে গত ১ নবেম্বর থেকে শুরু হওয়া পরীক্ষার প্রথম দিনে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ জন। কিন্তু ফরম পূরণ করেও পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়নি ৫৯ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী। ২ নবেম্বর দ্বিতীয় দিনে বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে বহিষ্কার হয় ২৩ জন। কিন্তু অনুপস্থিত ছিল ৬২ হাজার ৩১৮ জন। ৩ নবেম্বর ইংরেজী প্রথম পত্র পরীক্ষায় ২৭ জন বহিষ্কার হলেও অনুপস্থিত ছিল ৬০ হাজার ৬৯৮ জন। ৬ নবেম্বর ইংরেজী দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ৪৬ জন আর অনুপস্থিত ছিল ২৮ হাজার ৫১৮ জন। এরপর ৭ নবেম্বর ধর্ম পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ৩৩ জন, অনুপস্থিত ছিল ৫৭ হাজার ৬৯৪ জন। ৮ নবেম্বর অনুষ্ঠিত হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা, এখানে বহিষ্কার হয় ৮জন। কিন্তু কেন্দ্রে আসেনি ৫৬ হাজার ৪৪৬ জন। সর্বশেষ বুধবার অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় পরীক্ষায় বহিষ্কার হয় ১০জন। কিন্তু নিবন্ধন করেও পরীক্ষা কেন্দ্রে আসেনি ৫৭ হাজার ৪৪ জন শিক্ষার্থী। যারা পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, তাদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা প্রায় শতভাগ। তবে শিক্ষাবোর্ড আশা করছে, এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আগামী বছর পরীক্ষা দেবে। এদিকে অনুপস্থিতির ব্যাপক হার ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কেবল নকল কমালেই শিক্ষার লক্ষ্য পূরণ হবে না। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিশ্চিত করে রোধ করতে হবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার। নানা কারণে শিক্ষার্থীদের এই অব্যাহত ঝরে পড়ার পরিস্থিতিকে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার পথে অন্তরায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত তিন বছরের ব্যবধানে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে নানা কারণে। প্রধান কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক না করায় অষ্টম শ্রেণীতে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া, অসচেতনতার জন্য বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য, নদীভাঙ্গন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতাও রয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলছিলেন, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রতিবেদন অনুযায়ী ঝরে পড়ার সংখ্যা ৪০ শতাংশের বেশি। ঝরে পড়ার কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, টানাপোড়েনের সংসারে ছেলেদের পাঠানো হচ্ছে কাজে। আর নিরাপত্তার কারণে মেয়েদের আগেই স্কুল থেকে সরিয়ে নিয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করতে হলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে শিক্ষাকে। আর তা দ্রুত সম্ভব না হলে ঝরে পড়া কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। বন্ধ করতে হবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ভর্তির হার আশাব্যঞ্জক। তবে ঝরে পড়া রোধ করা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে এখনই ঝরে পড়া কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাধ্যমিকে ভর্তির পর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সচ্ছলতা আনতে অভিভাবকরা স্কুল থেকে বাচ্চাদের সরিয়ে নিচ্ছেন। সে কারণেই বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করতে হবে। অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে নবম শ্রেণী পর্যন্ত। জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবির ঝরে পড়ার সংখ্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রতিবছর অকৃতকার্য শিক্ষার্থী পরবর্তীতে উত্তীর্ণ হচ্ছে সত্য। বিদ্যালয়ে ভর্তির হারও আশাব্যঞ্জক, তবে প্রাথমিক সমাপনীতে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীর সঙ্গে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার যে তফাৎ, তা আসলে উদ্বেগজনকই। এ বিষয়ে সরকারের কাজ করা জরুরী।
×