ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মান্নান

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন এবং অতঃপর

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১১ নভেম্বর ২০১৬

আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন এবং অতঃপর

১৯৪৯-এর ২৩-২৪ জুন পুরনো ঢাকার রোজ গার্ডেন থেকে ২০১৬-এর ২২-২৩ অক্টোবর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান- আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন-২০১৬। ৬৭ বছরে ২০টি জাতীয় সম্মেলন। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের ইতিহাস বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ বাঙালীর গণজাগরণে ভোটে নিরঙ্কুশ জয়লাভ, ’৬৬ বাংলার স্বাধিকার ছয় দফা, ’৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ’৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার, মহান মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার- এমনি অসংখ্য জাতীয় জাগরণের অধিকারী আওয়ামী লীগ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে জেলে হত্যার পর ১৯৮১ সালে বড় দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন ৩৪ বছর বয়সী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার জ্যেষ্ঠ শেখ হাসিনা। সেই থেকে ৩৫ বছরে আওয়ামী লীগের ৮টি জাতীয় সম্মেলনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আটবারের সভানেত্রী। এবারও তিনি ছয় হাজার পাঁচ শ’ সত্তরজন কাউন্সিলরের কাছে সবিনয়ে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের অনুরোধ জানালে কাউন্সিলররা সমস্ব^রে তাঁর বিকল্প কাউকে এই মুহূর্তে গ্রহণ করতে রাজি নয় বলে জানান। এমনকি তিনি সভাপতির পদ গ্রহণ না করলে কাউন্সিলররা সভাস্থল ত্যাগ করবেন না এবং তাঁকেও যেতে দেবেন না। গণমানুষের আস্থা নির্ভরতায় আপ্লুত হয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর প্রস্তাবে এবং সব কাউন্সিলরের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অভিপ্রায়ে তিনি অষ্টমবারের মতো সভাপতি পদ গ্রহণ করেন। এবারের সম্মেলনে সেøাগান ছিল ‘উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।’ এই সেøাগান সেদিনের সেই রোজ গার্ডেনের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে পাড়া-মহল্লায় পৌঁছে গেছে সম্মেলনের আমেজ। জেলায় উপজেলায় থানায় এমনকি গ্রামে গ্রামে সম্মেলন ঘিরে আনন্দ মিছিল। ঐতিহাসিক সোহ্রওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের জন্য নির্মাণ করা হয় ১৫০ ফুট লম্বা ৮৪ ফুট চওড়া নৌকা আকৃতি মঞ্চ, যা মাটি থেকে ২৫ ফুট উঁচু। নৌকার মঞ্চটি যেন সমুদ্র থেকে ভাসমান দুর্বার ভঙ্গিতে দ-ায়মান। মঞ্চের প্রথম সারিতে ১৩টি আসন, দ্বিতীয় সারিতে ৫৮ জন তারপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ৭৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আসন। মঞ্চের পেছনে ৩৫ ফুট উচ্চতার এলইডি পর্দা স্থাপন করা হয়েছে। মঞ্চের সামনের দিকে স্বচ্ছ কাঁচের খুঁটিবিহীন একটি গ্যালারি তৈরি করা হয়। যেখান প্রায় সাত হাজার অতিথি আসন গ্রহণ করেন। প্রায় ৫০ হাজার অতিথির আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৩ অক্টোবর ৬ হাজার ৫৭০ জন কাউন্সিলর অংশগ্রহণ করেন। বিদেশী অতিথিদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়েছেন। শেখ হাসিনার উদ্বোধনী বক্তৃতা, জাতীয় সঙ্গীত, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পাঠ, জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। প্রথাসিদ্ধভাবে অধিবেশনে বিভিন্ন জেলার পক্ষে সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক সংগঠনের রিপোর্টসহ নীতিনির্ধারণমূলক বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সভাপতির রুলিং সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক যিনি সংসদ সদস্য নন তিনি বক্তব্য দেন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। সংযোজিত করা হয় ভিশন টুয়েনটি টুয়েনটিওয়ান এবং টুয়েনটি ফোরটিওয়ান। তাছাড়া গঠনতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য সংশোধনী করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির আকার ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮১, প্রেসিডিয়াম সদস্য ১৫ থেকে বাড়িয়ে ১৯, যুগ্ম সম্পাদক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৪, সাংগঠনিক সম্পাদক ৭ থেকে বাড়িয়ে ৮ এবং সদস্য পদে দুটি পদ বাড়ানো হয়েছে। এদিকে যুদ্ধাপরাধী এবং ১৫ আগস্টের খুনীদের উত্তরাধিকারীরা কেউ আওয়ামী লীগের কোন পর্যায়ের সদস্য হতে পারবে না মর্মে একটি ধারা গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে গঠনতন্ত্রের ২৭ ধারায় একটি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। এখানে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের উল্লেখ করা হয়েছে। এই বোর্ড হবে ১৯ সদস্যবিশষ্ট। গঠতন্ত্রের ৪৬-এর ঠ ধারায় জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শব্দটি যোগ করা হয়েছে। বর্তমান গঠনতন্ত্রের ৫-এর ৩ ধারায় সদস্য পদের মেয়াদ বৈশাখ থেকে চৈত্র মাসের পরিবর্তে জানুয়ারি-ডিসেম্বর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বর্তমান ঘোষণাপত্রে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের পরিবর্তে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প প্রচলন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হবে দরিদ্রতা। ব্লু-ইকোনমি-সমুদ্র সম্পদভিত্তিক উন্নয়ন একটি নতুন সংযোজন। আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শনে এবার নতুন যুক্ত হয়েছে ব্লুু-ইকোনমি। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সাফল্যের সুবর্ণ ফসল মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি। এর ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে সমুদয় অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এর বাইরে মহাদেশীয় বেষ্টনী এবং একইভাবে ভারতের সঙ্গে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহাদেশীয় বেষ্টনীর মধ্যে সব ধরনের সম্পদের ওপর বাংলাদেশর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমুদ্র খাত, যা ব্লু-ইকোনমি নামে অভিহিত, বাংলাদেশের উন্নয়নে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে দেশের উন্নয়নের চাকায় নতুন গতি সঞ্চারের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রয়োজন। অর্থনীতির ভাষায় বলে ‘সজোরে ধাক্কা’ (বিগ পুশ)। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ১০টি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো- স্বপ্নের পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা দ্রুত গণপরিবহন, এলএনজি ফ্লোটিং স্টোরেজ এ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট, মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১২৯.৫ কিমি রেললাইন স্থাপন ও কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল ইত্যাদি। পশ্চিমা উন্নয়ন সহযোগিতা ও চীন-রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রাখাসহ ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার এবং তা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করা হবে। ভারতসহ সুদৃঢ় করা হবে রাশিয়া, চীন এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। সম্মেলন সব দল-মতের মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। পৃথিবীর ছোট-বড় বহু দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়ে এই সম্মেলনকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশেষ করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার ১২টি দেশের ৫৫ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৭ জন শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন। বিদেশী অতিথিবৃন্দ এক বাক্যে বলেছেন- ‘আপনি শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ারই একজন নেতা।’ জননেত্রী শেখ হাসিনা শুধু একজন রাজনীতিক নন, তিনি একজন স্টেটসম্যানও। দেশের রাজনীতিতে বহু আকাক্সিক্ষত স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বস্বীকৃত সাফল্য অর্জন করে তাঁর নেতৃত্ব আজ একটি ইনস্টিটিউশনে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে তাঁর নেতৃত্বের প্রভাব সুস্পষ্ট। তিনি এই প্রতিষ্ঠা নিজের যোগ্যতায় অর্জন করেছেন। এখন তিনি নিজের আলোকেই আলোকিত। সম্মেলনে নেতা-কর্মীদের বলেছেন, আত্মসংশোধন করুন, জনগণের পাশে দাঁড়ান, জনসাধারণের সঙ্গে থাকুন, তাদের মন জয় করুন। দেশের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি মহল্লায় যেসব নিঃস্ব গৃহহীন মানুষ আছে তাদের তালিকা পাঠান- এ দেশে কোন মানুষ গৃহহীন-ঠিকানহীন থাকবে না। তাদের সরকারী ব্যয়ে গৃহনির্মাণ করে একটি স্থায়ী ঠিকানার ব্যবস্থা করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সব মানুষের একটি স্থায়ী ঠিকানা অর্থাৎ বাসস্থান থাকবে, কর্মসংস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের পাশে থেকে মানুষের কাজ করে আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে হবে। আসন্ন নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প্রস্তাবে সর্বসম্মতভাবে ওবায়দুল কাদেরকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন কোন ধরনের সন্ত্রাস কোন অবস্থায়ই প্রশ্রয় দেয়া হবে না, যে কোন মূল্যে সন্ত্রাস নির্মূল করতে হবে। তিনি দুর্নীতিমুক্ত দায়িত্বশীল প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন। আইনের শাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চর্চায় নেতাকর্মীদের আত্মনিয়োগ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিবিদ
×