ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ মার্চেন্টকে পুশব্যাক করা হয়েছে!

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৮ নভেম্বর ২০১৬

দাউদ মার্চেন্টকে পুশব্যাক করা হয়েছে!

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ভারতীয় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গুলশান কুমার হত্যা মামলার আসামি বহুল আলোচিত মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ আব্দুর রউফ দাউদ মার্চেন্টকে সীমান্ত পথে পুশব্যাক করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের দায়িত্বশীল কোন সূত্র দাউদ মার্চেন্টের বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। মার্চেন্ট গ্রেফতারের পর গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালান, মানবপাচার, জালমুদ্রার ব্যবসাসহ বহু বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। এমনকি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পাকিস্তানের শীর্ষ জঙ্গী সংগঠনের প্রধানদের বাংলাদেশে হরহামেশা যাতায়াত এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ ছিল বলে প্রকাশ পায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে পাকিস্তান ও ভারতের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য প্রকাশ করে। গোয়েন্দা সূত্র মতে, মূলত ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত তথ্য আদান-প্রদানের সূত্র ধরেই দাউদ মার্চেন্টের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ২৭ মে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার একটি বাড়ি থেকে দাউদ মার্চেন্ট ও তার আশ্রয়দাতা জাহিদ শেখকে ২৯ মে গ্রেফতার করা হয়। জাহিদ শেখ মাফিয়া ডন ছোটা শাকিলের ঘনিষ্ঠ। দাউদ মার্চেন্ট ও জাহিদ শেখকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। পরে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা হয়। ২০১৪ সালের ১৯ নবেম্বর দাউদ মার্চেন্ট আদালত থেকে জামিন পায়। জামিনের কাগজপত্র ২৯ নবেম্বর কারাগারে পৌঁছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দাউদ মার্চেন্টকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পরই গোয়েন্দা পুলিশ আবার মার্চেন্টকে আটক করে। এতদিন ৫৪ ধারায় গ্রেফতার হিসেবে কারাগারে ছিল মার্চেন্ট। গত ৩ নবেম্বর ৫৪ ধারার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেলসুপার জাহাঙ্গীর কবির জানান, মার্চেন্টের মুক্তির আদেশের কাগজপত্র যাচাইবাছাই শেষে গত ৬ নবেম্বর রবিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আব্দুর রউফ ওরফে দাউদ মার্চেন্টকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির পর থেকেই মার্চেন্টের অবস্থান সর্ম্পকে সুস্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তার কারাবাসের মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছে। এজন্য তাকে মুক্তি দেয়া হয়। কারাগার থেকে মুক্তির পর মার্চেন্টের অবস্থান কোথায় তা স্পষ্ট করেননি মন্ত্রী। এমনকি ভারতের তরফ থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। দাউদ মার্চেন্টকে ফেরত দিয়ে বাংলাদেশের মোস্টওয়ান্টেড একাধিক অপরাধীকে ফেরত পাওয়ার গুঞ্জন ছিল। কিন্তু জামিনের পর মার্চেন্টের অবস্থান সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না প্রকাশিত হওয়ায় সেসব আলোচনা তেমন হালে পানি পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মার্চেন্টকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার আগেই সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। মুক্তির পর মার্চেন্টকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বিশেষ ব্যবস্থায় গাড়িতে করে বাংলাদেশÑভারত সীমান্তে নিয়ে যায়। সেখানেই ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে পুশব্যাক করা হয়। যদিও বাংলাদেশ ও ভারতের কোন দায়িত্বশীল সূত্রই বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশনের দুজন উর্ধতন কর্মকর্তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দাউদ মার্চেন্ট ও তার সহযোগী জাহিদ শেখের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারা মোস্টওয়ান্টেড দুই ভারতীয়কে ফেরত পেতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তি পায় দাউদ মার্চেন্ট। প্রসঙ্গত, ভারতের মুম্বাইয়ের সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টি-সিরিজের মালিক বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গুলশান কুমারকে ১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট আন্ধেরী এলাকার একটি মন্দির থেকে বের হওয়ার সময় গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন ভাড়াটে খুনী হিসেবে দাউদ মার্চেন্টকে গ্রেফতার করে ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই মামলায় ২০০২ সালে ভারতীয় আদালত দাউদ মার্চেন্টকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করে দাউদ মার্চেন্ট। কারাগারে থাকা অবস্থায়ই পারিবারিক কারণে ২০০৯ সালে ১৪ দিনের প্যারোলে মুক্তি পায় মার্চেন্ট। মুক্তি পেয়েই ব্রাক্ষণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দাউদ মার্চেন্ট ও জাহিদ শেখ রিমান্ডে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ, মানবপাচার, জঙ্গী প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশী ও ভারতীয় জঙ্গীদের পাকিস্তানে পাঠানো, অস্ত্র-গোলাবারুদ, মাদক, জালমুদ্রার ব্যবসাসহ বহু অজানা তথ্য দিয়েছে। তারা দু’জনই বাংলাদেশে উর্দুভাষী অবাঙালী হিসেবে বসবাস করত। পাসপোর্ট দালাল চক্রের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করেছিল। জাহিদ শেখ আগে বাংলাদেশে আত্মগোপন করে। আত্মগোপনে থাকার সময় ২০০৪ সালে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের হাতে একবার গ্রেফতারও হয়েছিল। ওই সময় নিজেকে উর্দুভাষী অবাঙালী পরিচয়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তার প্রধান কাজই ছিল ভারতীয় সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশে আত্মগোপনে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া। দালালদের মাধ্যমে ভারত থেকে আসা সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করে দিত। পাসপোর্ট নিয়ে ভারতীয় সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশী হিসেবে এদেশে বসবাস করত। জাহিদ শেখের সঙ্গে পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী একাধিক জঙ্গীগোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল। তাদের মাধ্যমে অনেক বাংলাদেশী ও ভারতীয় জঙ্গীকে সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণের জন্য পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়ার কাজটিও করত। জাহিদের সঙ্গে দাউদ মার্চেন্টের আগেই যোগাযোগ হয়। মার্চেন্ট জাহিদের পরামর্শেই ব্রাক্ষণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করে। তারা ভারতের বহু শিবসেনা হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অবলীলায় স্বীকার করেছে। জাহিদ ভারতের জঙ্গী সংগঠন আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের ভারতের মোস্টওয়ান্টেড জঙ্গীদের সম্পর্কেও তথ্য দেয়। দাউদ ইব্রাহিমের দুই সহযোগী দাউদ মার্চেন্ট ও জাহিদ শেখের তথ্যের ভিত্তিতে মাফিয়া ডন ছোটা শাকিলের আরেক সহযোগী ভারতের মোস্টওয়ান্টেড আরিফ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। এ তিন ভারতীয় সন্ত্রাসীকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর কাহিনী। গ্রেফতারকৃতরা প্রকাশ করে দেয় ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্ন্তজাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা। তাদের তথ্য মোতাবেক ২০০৯ সালের ১৬ জুলাই ভারতের মোস্টওয়ান্টেড ও বহুবার আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া দুর্ধর্ষ শীর্ষ জঙ্গী নেতা ও সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞ মুফতি মাওলানা ওবায়দুল্লাহ গ্রেফতার হয়। ওবায়দুল্লাহ পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ নেতা খুররম খৈয়ামের নির্দেশে বাংলাদেশে কাজ করছিলেন। বাংলাদেশের বহু নাশকতার কলকাঠিও নেড়েছে লস্কর-ই-তৈয়বার এই শীর্ষ নেতা। লস্কর-ই-তৈয়বার আরেক নেতা আফগান ফেরত যোদ্ধা মুফতি রউফ প্রথম পাকিস্তানের তৈরি ১৬টি আর্জেস-৮৪ মডেলের গ্রেনেড, অত্যাধুনিক চাইনিজ কার্বাইন রাইফেল ও গোলাবারুদসহ গ্রেফতার হয়। লস্কর-ই-তৈয়বার শীর্ষ নেতা আমির রেজা খানের সঙ্গে বাংলাদেশের হরকত-উল-জিহাদের সর্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে। ওবায়দুল্লাহর তথ্য মোতাবেক ২০০৯ সালের ২০ জুলাই ঢাকার দক্ষিণখান এলাকার হরকত-উল-জিহাদের এক নেতার পরিচালিত মাদ্রাসাতুর রহমান থেকে ভারতীয় শীর্ষ জঙ্গী মোস্টওয়ান্টেড মাওলানা মুনসুর আলী গ্রেফতার হয়। মুনসুর আলী বাংলাদেশে লস্কর-ই-তৈয়বার প্রধান সংগঠক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি সমরাস্ত্র ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তাদের গ্রেফতার করতে ভারতীয় কমান্ডোরা পুরো ভারত চষে বেড়িয়েছেন। মুনসুর আলীর তথ্য মোতাবেক বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠনগুলোর প্রধানদের হরহামেশা যাতায়াত ছিল। পরবর্তীতে এমদাদুল্লাহ ওরফে মাহবুব নামে আরও এক ভারতীয় মোস্টওয়ান্টেড জঙ্গী গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতরা বাংলাদেশে অবস্থান করে ভারতের আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্স, পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদীয়া, ইসলামীয়া আজাদীয়া ও লস্কর-ই-তৈয়বার কর্মকাণ্ড পরিচালিত করত। এমদাদুল্লাহ পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত। সে সবধরনের হালকা ও ভারি অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। সে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বোমা ও গ্রেনেড প্রস্তুতে সক্ষম। এমদাদুল্লাহ গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ জঙ্গী ভারতীয় মোস্টওয়ান্টেড মুনসুর আলীর আপন ভাতিজা। এমদাদুল্লাহ একে-৪৭ রাইফেল, এসএলআর, মেশিনগান, রকেট লঞ্চার, স্নাইপার রাইফেল চালনায় বিশেষ পারদর্শী। এছাড়া বিস্ফোরকের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ ও জেএমবির সর্বক্ষণিক সম্পর্ক ছিল বলে স্বীকার করে। তাদের সঙ্গে লস্কর-ই-তৈয়বা ছাড়াও জইশ-ই-মোহাম্মদ, জইশ-ই-মোস্তফা, ভারতের কামতাপুর লিবারেল ফ্রন্ট, অসমের বিচ্ছিন্নতাবাদী উগ্রপন্থী দল উলফা, কাশ্মীরের আসিফ রেজার কমান্ডো ফোর্সসহ বহু জঙ্গী ও উগ্রপন্থী দলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এসব দলের বাংলাদেশে ঘাঁটিও ছিল।
×