ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কুখ্যাত মোনায়েম খানের আরেক কীর্তি

বাগ ই মোনায়েমে বরাদ্দ দশ কাঠা, দখলে পাঁচ বিঘা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৮ নভেম্বর ২০১৬

বাগ ই মোনায়েমে বরাদ্দ দশ কাঠা, দখলে পাঁচ বিঘা

আরাফাত মুন্না ॥ ইট-পাথরে গড়া এই শহরে বসবাসকারী নাগরিকদের একটু প্রশান্তি দিতে সরকার কত কি ব্যবস্থা নেয়। নগরের মানুষদের জন্য গড়ে তোলে পার্ক-লেকসহ আরও কত কি। রাজধানীর বনানীতেও এমনি একটি সবুজ ভূমি থাকার কথা ছিল নাগরিকদের স্বস্তির জন্য। তবে জায়গা কোথায়? যে জায়গাটা রাখা হয়েছিল ওই সবুজ ভূমির জন্য, তা দখল করে আছে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খানের বংশধররা। দেশ স্বাধীনের আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর মোনায়েম খান নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের (ডিআইটি) (বর্তমান রাজউক) কাছ থেকে ১০ কাঠা জমি বরাদ্দ নিলেও ওই সময়ই বনানী কবরস্থান সড়কে সরকারী ৫ বিঘা জমিও দখল করে নেন, যা স্বাধীনতার এত বছর পরও দখল মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, মোনায়েম খান একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, তাকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। এর পরেও এই যুদ্ধাপরাধীর বংশধররা এতবড় একটি সম্পত্তি দখল করে রাখে কিভাবে। সরকার হাতিরঝিল প্রকল্পের জন্য র‌্যাংকস ভবন পর্যন্ত ভেঙ্গে দিয়েছে, তবে বনানীতে সবুজ ভূমি করার জন্য যুদ্ধাপরাধী পরিবারের দখলে থাকা ওই পাঁচ বিঘা সম্পত্তি কেন দখলমুক্ত করা যাবে না। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা যে সব সময় ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করছে এখানে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। এই জমিতেও একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খার নামেই। এছাড়া এই যুদ্ধাপরাধীর দুই মেয়ে অন্বেষা নামে একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছেন। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ওই জমিতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে। তবে এর পরই আদালত থেকে সাত দিনের স্থিতি অবস্থা জারির আদেশ নিয়ে আসে মোনায়েম খানের পরিবার। এর ফলে উচ্ছেদ কাজ আর এগুনো যায়নি। এই জমিতে থাকা অবৈধ স্থাপনার কারণে বনানীর ২৭নং সড়কটি সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছিল। যে কারণে সেখানে সব সময় যানজট লেগে থাকে। যানজট নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণের সময় সিটি কর্পোরেশনের দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় যে, জমিটি অবৈধভাবে দখল করা। আর দখলকারী একজন চিহ্নিত কুখ্যাতজন। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ৫০ বছরেরও বেশি সময় আগে ৫ দশমিক ১৫ বিঘা জমি বরাদ্দ নেয় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খান। স্বাধীনতার পর থেকেও তার পরিবারের সদস্যরাই ওই জমিটি দখল করে রেখেছে। তিনি বলেন, কিন্তু আমরা রাজউকের (সাবেক ডিআইটি) প্ল্যানে দেখেছি, কবরস্থানের ওই পাশটা (মোনায়েম খানের বাড়ি) সবুজ ভূমি (গ্রিন ল্যান্ড)। গাছ লাগানো, ফুটপাথ করার জন্য ওই জায়গাটি রাখা ছিল। ওই জায়গাটি দেখলেই একটু ভিন্ন মনে হতো। মেয়র বলেন, পরে আমরা রাজউককে জানানোর পর যৌথ সার্ভে করে দেখা গেল জায়গাটি তারা অবৈধভাবে দখলে রেখেছে। এর পরপরই আমরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি। এখন ওই উচ্ছেদ অভিযানের ওপর স্থিতি অবস্থা জারি রয়েছে বলেও মেয়র জানান। আনিসুল হক বলেন, একজন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, প্রথমত ঢাকা শহরে কারও কাছে এতবড় জায়গা একার থাকা উচিত নয়। একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর কাছে তো নয়ই। এটা এখন সরকারের বিষয়, তবে সিটি কর্পোরেশনের বিষয় হলো আমাদের জায়গা দখল রাখা যাবে না, বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ বিষয়ে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দীর্ঘকাল ধরে বলছি, একাত্তরের ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফত করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা জেনে বিস্মিত হয়েছি, মোনায়েম খানের মতো একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী যাকে হত্যা করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। সেই মোনায়েম খানের পরিবার পাঁচ বিঘা জমি কিভাবে দখল করে রেখেছে। পাকিস্তান সরকার বা যে কোন সরকারই এই জমি বরাদ্দ দিক তা বেআইনী। বাংলাদেশের কোন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকেও পাঁচ বিঘা সরকারী সম্পত্তি বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করব সরকার অবিলম্বে এই সম্পত্তি বাজেয়াফত করে শহীদ পরিবার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করবে। যারা দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তাদের কোন সম্পত্তি থাকতে পারবে না। পৃথিবীর সব দেশেই স্বাধীনতা বিরোধীদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হয়েছে। জার্মানীতে নাৎসীদের কোন সম্পত্তি নেই। তাদের যাবতীয় সম্পত্তি জার্মানীর সরকার বাজেয়াফত করেছে। সরকারকে অবিলম্বে মোনায়েম খানসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর সম্পত্তি বাজেয়াফত করে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও তিনি দাবি জানান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়টিতে রাষ্ট্রের নজর দেয়া উচিত। সরকারকে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াফত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তাদের সম্পত্তিতো শত্রু সম্পত্তি হয়ে গেছে। ফলে ওইসব সম্পত্তি রাষ্ট্রায়াত্ত করা খুবই জরুরী। সরকারকে দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য, পাকিস্তান পর্বে সামরিক জান্তা শাসক আইয়ুব খানের পদলেহী হিসেবে চিহ্নিত ‘বটতলার উকিল’ হিসেবে পরিচিত মোনায়েম খান পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে সেই সময় ছিল ঘৃণিত। বিশ্বস্ত এবং বশংবদ বলেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর পদে বসান ১৯৬২ সালে। বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে তার নিন্দিত অপতৎপরতা সর্বত্র ঘৃণার অধিকারী এই ব্যক্তি আবদুল মোনায়েম খান। দেশবাসী তো বটেই স্থানীয় জনগণও তাকে ঘৃণার চোখে দেখে এখনও। পারতপক্ষে তাই এই বাড়িটিতে কেউ যায় না। ঊনসত্তর সালে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের সঙ্গে সঙ্গে তার কেনা গোলাম মোনায়েম খানও ক্ষমতাচ্যুত হয়। তারপর আত্মগোপনে থাকে। একাত্তরে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণহত্যা এবং বাঙালীবিরোধী সশস্ত্র কর্মকা-কে সমর্থন জানিয়ে হানাদারদের সহযোগী হিসেবে ঘৃণ্য তৎপরতা চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ বাড়ে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক তাকে নিধন করে। হানাদার বাহিনী তার লাশ দাফন করলেও মুক্তিযোদ্ধারা কবর উপড়ে ফেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশ্বাসঘাতক মোনায়েম খান বনানীতে পাঁচ বিঘা জমি দখল করে নেয়। তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমান রাজউক) তাকে ১০ কাঠা জমি বরাদ্দ করেছিল। এর আয়তন ছিল লম্বায় ২০২ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। পরে একাত্তরেই বনানী কবরস্থান সড়কে সরকারী পাঁচ বিঘা জমি দখল করে নেন মোনায়েম খান। লুটেরা চরিত্রের বহির্প্রকাশ এভাবেও ঘটিয়েছে সে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের মোয়ায়েম খান ছিল মুসলিম লীগ নেতা। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন দমন ও বাঙালী নিধনে আইয়ুবসহ পাকিস্তানী হানাদারদের সহযোগী ছিল। তার এক নাতি সম্প্রতি কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় নিহত হয়। সে নব্য জেএমবির সদস্য।
×