ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে এই চুক্তিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে

মমতার সম্মতি পেলেই আলোর মুখ দেখবে তিস্তা চুক্তি

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৬ নভেম্বর ২০১৬

মমতার সম্মতি পেলেই আলোর মুখ দেখবে তিস্তা চুক্তি

তৌহিদুর রহমান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী মাসে ভারত সফরে তিস্তা চুক্তিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে ঢাকা। দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এ চুক্তির বিষয়ে এখন ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে আলোচনাও চলছে। তিস্তা চুক্তি সম্পন্নের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনাও শুরু করেছে দিল্লী। এছাড়া এ চুক্তির বিষয়ে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের সঙ্গেও ইতোমধ্যেই আলোচনা সেরে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তির জট খুলতে কাজ শুরু করেছে ঢাকা-দিল্লী। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে একাধিকবার আলোচনাও হয়েছে। তবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সিকিম থেকে তিস্তায় পানিপ্রবাহের নিশ্চয়তা চেয়ে আসছিল পশ্চিমবঙ্গ। সে কারণে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে দিল্লী। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী গত ২৩-২৭ অক্টোবর দিল্লীতে ছিলেন। সে সময় তিনি দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিদ্যুতমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তিতে তার কোন আপত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক আগামী মঙ্গলবার দিল্লী যাচ্ছেন। সেখানে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে কী কী চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে, সে বিষয়েও আলোচনা করবেন দুই পররাষ্ট্র সচিব। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে এক বৈঠক শেষে বলেছেন, ‘আগামী ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করবেন। সে সফরের সময় তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক সমাধান আসবে বলে আমি আশাবাদী। বাংলাদেশ ও ভারতের মাইন্ডসেট ঠিক আছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের কোন আপত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে যেটুকু সমস্যা আছে তা সমাধান হবে।’ সূত্র জানায়, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ঢাকার প্রস্তুতি রয়েছে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালেই তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত ছিল। সেটিতেই বাংলাদেশের সম্মতি রয়েছে। তাই নতুন করে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে হবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ম্যানেজ করতে পারলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের সময় তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যার মধ্যে একটি ছিল সীমান্ত চুক্তি, অপরটি তিস্তা চুক্তি। তবে নানা কারণে এ দুটি চুক্তি একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এখনও তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। আর তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে এক সময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে পারছে না মোদি সরকারও। তাই যেভাবেই হোক মমতাকে রাজি করিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে চায় দিল্লী। সে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছরের ৬ জুন ঢাকা সফরে এলে মমতাকেও সফরসঙ্গী করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা-মোদির একসঙ্গে বৈঠকও হয়। বৈঠকে ভারতের দুই নেতাই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করে আসছেন, সিকিম থেকে তিস্তায় পানি সরবরাহ কমে আসছে। কেননা সিকিম সরকার তিস্তার মুখে চারটি বাঁধ দিয়ে বড় বড় বিদ্যুত প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ওই বাঁধের কারণেই শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি আসে না। তাই তিস্তা চুক্তি হওয়ার আগেই সিকিম থেকে পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে চান মমতা। তিনি বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও জানিয়েছেন। এছাড়া মমতা নিজেও সিকিম সরকারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনার জন্য আগ্রহও প্রকাশ করেছেন। তবে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং জানিয়েছেন, সিকিমের বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমছে না। বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য তিস্তা থেকে নেয়া পানি আবার তিস্তায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই বলেও জানান তিনি। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা কখনই বলেননি যে, তিনি এ চুক্তির বিপক্ষে। তিনি সব সময় বলে আসছেন, তিস্তা চুক্তিতে তিনি আগ্রহী। তবে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখেই তিস্তা চুক্তিতে আগ্রহী বলে মমতা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি করে তিনি তিস্তা চুক্তির পক্ষে আগ্রহী নন। আর সিকিম থেকে ঠিকমতো পানি পেলেই পশ্চিমবঙ্গের এ বিষয়ে কোন আপত্তি নেই বলেও মমতা জানিয়েছেন। দিল্লীর কূটনৈতিক সূত্র জানায়, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়া যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে পাশে রেখেছিলেন, মোদিও ঠিক সেভাবেই মমতাকে পাশে রেখে তিস্তা চুক্তি করতে চাইছেন। তিস্তায় যাতে উজান থেকে বেশি পানি আসে এবং পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ তাদের হিস্যা পায় সেজন্য সিকিমের সঙ্গেও আলোচনা করেছে মোদির কেন্দ্রীয় সরকার। কেননা সিকিমের পানিই তিস্তায় প্রবাহিত হচ্ছে। কোন বাধা ছাড়াই যাতে সিকিমের পানি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে আসতে পারে, সেটাই নিশ্চিত করতে আগ্রহী মোদি সরকার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত বছর ঢাকা সফরের আগেই বহুল আলোচিত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হবে না, তা আগেই ভারতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছিল। তখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন, সবকিছু রাতারাতি হয় না। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। মোদির ঢাকা সফরের একদিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তিস্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। ডিপ্লোমেসিতে সবকিছু তো পাবলিকলি হয় না। অনেক কিছুই চোখের আড়ালে হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। ঢাকা সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আমি আত্মবিশ্বাসী যে, ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর সহযোগিতায় তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছতে পারব। আমাদের নদীগুলো দূষণমুক্ত ও নাব্য বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করব। আমাদের নদীগুলো আমাদের সম্পর্ককে লালন করবে, বিভেদের উৎস হবে না। নদী সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে তা প্রভাবিত করে। পানি একটি মানবিক ইস্যু, যা আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেব। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে আপত্তি তোলায় বিষয়টি আটকে যায়। এর প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসে শীঘ্রই তিস্তার জট খোলার আশা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর মোদির ঢাকা সফরের সময় মমতারও আসার আলোচনা শুরু হলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আবারও বেঁকে বসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি না করার আশ্বাস দিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরে আসতে রাজি করান। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত রূপ দিতে চায় বিজেপি সরকার। মমতা গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরে এসে তিস্তার বিষয়ে তাঁর প্রতি আস্থা রাখতে বলেন। তবে তিনি আস্থা রাখতে বললেও তাঁর বিরোধিতার কারণেই ২০১১ সালে তিস্তা চুক্তি হতে হতেও আটকে যায়। ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সফরে আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নেন মমতা। তিনি তখন বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে এ চুক্তি তিনি সমর্থন করতে পারেন না। তবে মনমোহনের সেই সফরে স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকল সই হয়, যার মধ্য দিয়ে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের পথ খোলে। কিন্তু ওই প্রটোকল কার্যকর করতে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হওয়ায় বিষয়টি ঝুলে থাকে। এরপর মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর লোকসভায় সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের মধ্য দিয়ে ছিটমহল সমস্যার সমাধান করা হয়। ভারতের মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি বিষয় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করলে সীমান্ত ও তিস্তা চুক্তির জট খোলার আশা তৈরি হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ অধিবেশনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে তিস্তা চুক্তি সইয়ের বিষয়েও জোর চেষ্টা চালানোর আশ্বাস দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে মমতা বাংলাদেশ সফর নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে মমতা লেখেন, তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে তার বিরোধিতা নেই। এ চুক্তির জট খুলতে তিনি মোদিকে সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত রয়েছেন। চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর ভারতের গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনে যোগদানের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটি সফরের জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত বছরের ৬-৭ জুন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। আসন্ন ভারত সফর হবে মোদি সরকার ক্ষমতায় বসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। যদিও ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর স্ত্রীর মৃত্যুর সময় শেখ হাসিনা সংক্ষিপ্ত সফরে দিল্লী গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে সন্ত্রাস দমনে দুই দেশ পরস্পরকে সমর্থন করছে। রাজধানীর গুলশানে সন্ত্রাসী হামলার পর মোদি এক বার্তায় শেখ হাসিনার পাশে থাকবেন বলে অঙ্গীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের জন্য প্রাথমিকভাবে আগামী মাসের ৩-৪ তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ওই সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
×