ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এম. আমীর উল ইসলাম

বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৬ নভেম্বর ২০১৬

বাংলাদেশের সংবিধানের পটভূমি

(গতকালের পর) সেইসঙ্গে প্রতিটি নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার-যথা আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণের কারণে বৈষম্য দূরীকরণ, সরকারী নিয়োগ লাভে সুযোগের সমতা, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা, গ্রেফতার ও অবৈধ আটক সম্পর্কে অধিকারের রক্ষাকবচ, জবরদস্তি শ্রম ও নিবর্তনমূলক আটকের ব্যাপারে বিধিবদ্ধতা, বিচার ও দ- স¤পর্কে বিধিবদ্ধতা রক্ষাকরণ, ভ্রমণের স্বাধীনতা, সংগঠনের অধিকার, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্ স্বাধীনতা, পেশা, ধর্ম পালন ও সস্পত্তি ভোগের অধিকার, গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ, মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের অধিকার- এসবই আমাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে। এ সকল অধিকার বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদে এবং আন্তর্জাতিক দুটি অঙ্গীকারনামায় সন্নিবেশিত। উপরন্তু মানবিক ও মানবসত্তার মর্যাদা আমাদের সংবিধানেই শুধু স্থান লাভ করেছে। কারণ এ অধিকার কিভাবে স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার ও শক্তিধরদের কাছে নিষ্পেষিত হয় বংশপরম্পরায় আমরা স্বেচ্ছাচারী শাসকদের দুঃশাসনের শিকার হয়েছি। প্রতিটি মানুষ ও তাদের পরিবার বংশপরম্পরায় শোষণ, বঞ্চনা ও অন্যায় এবং অত্যাচারের শিকার ও সাক্ষী। বাংলাদেশের বীর যোদ্ধাদের লড়াই ছিল জঘন্য গণহত্যার বিরুদ্ধে মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার। তাই বাংলাদেশের সকল মানুষই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বীরযোদ্ধা। সেই গৌরবোজ্জ্বল বীরত্বের ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালী তাই এগিয়ে চলেছে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রতিটি মানুষের এবং মানবসত্তার মর্যাদা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। স্বাধীনতার চেতনাবোধ আর স্বাধীন সত্তার গৌরবম-িত অধিকারের উচ্চারণ ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতি তার স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে; কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’ এ উপলব্ধি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। সংবিধানের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য অক্ষুণœœ রাখার পবিত্র অঙ্গীকার বার বার ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নৃশংসভাবে হত্যা বাঙালী জাতির ললাটে কলঙ্কলেপন করেছে। এই কলঙ্কের সঙ্গে যোগ হয়েছে একটার পর একটা ব্যর্থতা। সংবিধানে স্বাধীনতার প্রথম স্বাক্ষরে জাতির পিতা উচ্চারণ করেছিলেন ‘জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক’ এবং ‘যে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সস্পত্তির নিশ্চয়তা বিধান হবে আইনের আশ্রয় লাভের মাধ্যমে’। অথচ ’৭১-এর গণহত্যার বিচার আজও অনুষ্ঠিত হয়নি। স্বাধীনতার প্রাণ পিতাকে হত্যা করা হলো। তাঁর জীবন ও দেহের নিরাপত্তা ঘাতকরা ছিনিয়ে নিল। সেই জঘন্য অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নানাভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে গত ৩৪ বছর। তেমনি বিচার হয়নি আরও অনেক হত্যা ও অপরাধের। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে কেউ বন্দীশালায়, কেউ পুলিশ হেফাজতে, কেউবা সভায় বা মিছিলে, নিজের গৃহে বা শিক্ষাঙ্গনে। রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে। এমন অজস্র হত্যা, ধর্ষণের বিচার এখনও হয়নি, অনুসন্ধান বা তদন্ত থামিয়ে দেয়া হয়েছে অথবা ধামাচাপা পড়েছে নানাভাবে। এভাবে অতীতে রাজনীতিকে অপরাধ আর সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগসূত্র সৃষ্টি করে সমাজকে ধ্বংস সীমানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আইনকে করা হয়েছিল নীরব দর্শক। আর জনগণের মৌলিক অধিকার ছিল বন্দী। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন এবং দেহের নিরাপত্তা এসব থেকে জাতির প্রাণ পিতা ও তাঁর পরিবারকে যেমন বঞ্চিত করা হয়, তেমনি জনগণ একই ধারাবাহিকতায় আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত। আইনের শাসন থেকে প্রাক্তন মন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া গ্রেনেড হামলার শিকার হন, তারই প্রতিবাদে ২১ আগস্ট জনসভা। ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেন। কিন্তু আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত ও শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। তার সঠিক তদন্ত করতে দেয়া হয়নি। তদন্তের নামে আসল আসামিদের আড়াল করা হয়েছে। এ কোন্ আইনের শাসন? এ কোন্ মানবাধিকারের বাস্তবায়ন? আইন প্রক্রিয়ায় এ সীমাবদ্ধতা বা অক্ষমতা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, আইনের শাসনের এমন অসহায় পরাজয় জনগণ মেনে নেয়নি। তাই বিপুল ভোটে বিজয়ী সরকারের কাছে বাংলার মানুষের সাংবিধানিক প্রত্যাশা আর এই সরকারের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির আন্তরিক বাস্তবায়ন পন্থা ও উপযুক্ত কৌশল রচনা সময়ের সবচেয়ে জরুরী দাবি। এছাড়াও রয়েছে সংবিধানের স্খলন। পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় ধর্ম সৃষ্টির মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মাঝে ভেদ সৃষ্টি, অর্পিত ও শত্রু সস্পত্তি আইনকে অব্যাহত রাখার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকারের বৈষম্য সৃষ্টি, অবৈধ ক্ষমতা দখল ও অসাংবিধানিক সকল ক্রিয়াকর্ম এবং পরিবর্তনকে বৈধতা দান এসবই ঐরূপ স্খলনের উদাহরণ। সংবিধান রক্ষা করার অঙ্গীকার করে যারা শপথ নিয়েছিল তাদের স্খলন আর সেইসঙ্গে সংবিধানকে রক্ষা করতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা এক ধরনের হতাশায় রূপ নিয়েছিল। এই অন্ধকারের অমানিশা থেকে বেরিয়ে এসে সংবিধানের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার দিন বদলের যে আহ্বান সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছে এদেশের জনগণ। ছিনিয়ে এনেছে নিরঙ্কুশ বিজয়। তাই বিজয় সংহত করে জনগণের সাংবিধানিক প্রত্যাশার বাস্তবায়ন সময়ের জরুরী দাবি। বর্তমান সংসদে যে প্রাণচাঞ্চল্য ও কমিটি প্রথার মাধ্যমে জবাবদিহির যে জায়গাটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে তা জনমনে আশার সঞ্চার করে। চলবে...
×