ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে সন্ত্রাসবাদ নেই

প্রকাশিত: ০৪:২২, ৪ নভেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে সন্ত্রাসবাদ নেই

॥ পর্ব-১ ॥ ইসলাম শব্দের ব্যুৎপত্তি সালম থেকে যার অর্থই শান্তি আর যে শান্তি সামগ্রিক শান্তি যা আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণের দ্বারা অর্জিত হয়। এই শান্তি মানুষের কল্যাণ সাধনে নিহিত, মানুষের ক্ষতি হয় এমন সব কর্মকা- থেকে নিবৃত্ত থাকার মধ্যে নিহিত। তাই তো পারস্পরিক অভিবাদন হচ্ছে আস্সালামু আলায়ইকুম ওয়া আলায়ইকুমুস্্ সালাম। জান্নাত হচ্ছে দারুস সালাম। আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, মানব কল্যাণ ও সৎকর্ম যারা করে তারাই মুসলিম শান্তি স্থাপনকারী। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে হ্যাঁ, যে কেউ আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎকর্মপরায়ণ হয় তার ফল তার রবের কাছে রয়েছে। (সুরা বাকারা : আয়াত ১১২) ইসলামের সঙ্গে জোর জবরদস্তি, বল প্রয়োগ নিপীড়ন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ প্রভৃতির কোন সম্পর্ক নেই। এ সবই ইসলামবিরোধী কর্মকা-, কেননা দীন বা ধর্ম নির্ভর করে বিশ্বাস ও আন্তরিক ইচ্ছার ওপর। বল প্রয়োগ করে কাউকে প্ররোচিত করা বা রাজি করানো ইসলাম সমর্থন করে না। ফিতনা ফাসাদ, ঝগড়া বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতি সৃষ্টি করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা ইসলামে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এ সবের জন্য ইসলামে সুনির্দিষ্ট শাস্তি বিধান রয়েছে। এমনকি মৃত্যুদ-েরও বিধান রয়েছে। কোন নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করাকে হারাম ঘোষণা করে ইরশাদ হয়েছে কেউ একজন মানুষকে হত্যা করল সে যেন সবার জীবন রক্ষা করল (সুরা মায়িদা : আয়াত ৩২) যারা সন্ত্রাসবাদী তারা ইসলামের দুশমন, তা শয়তানের অনুচর, তারা পথভ্রষ্ট। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান যুম্মরাইন রাদি আল্লাহ তায়ালা আনহুর ১২ বছর স্থায়ী খিলাফতকালের শেষার্ধের দিকে ইয়েমেনের আবদুল্লাহ ইবনে সাবাহ নামের এক ইয়াহুদী ইসলামে অনুপ্রবেশ করে। যে মদিনা মনওয়ারা থেকে দূরবর্তী কুফা, বসরা, ফুসতাত প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়ে নিজেকে ইসলাম দরদী হিসেবে জাহির করে খলিফা উসমান রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে একশ্রেণীর তরুণকে উদ্বুদ্ধ করে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। তিন হাজারের মতো লোককে সে সংঘবদ্ধ করে। তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে হজের নাম করে ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মক্কা মুকাররমায় না গিয়ে মদিনা মনওয়ারার নিকটবর্তী খানে জড়ো হয় রাতের অন্ধকারে এবং মদিনা মনওয়ারায় ঢুকে পড়ে হযরত উসমান রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুর বাস ভবনের পেছনের দেয়াল টপকিয়ে গৃহ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তখন ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল। হযরত উসমান রাদি আল্লাহ তায়ালা আনহু সালাত আদায় করে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করছিলেন। ওই অবস্থায় দুষ্কৃতকারীরা তলোয়ার দিয়ে তাঁকে আঘাত করে। তাদের তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তলোয়ারের আঘাত ঠেকানোর জন্য তার বিবি সাহেবা হযরত মায়িলা হাত বাড়িয়ে দিলে তার হাতের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে মেঝেতে পড়ে যায়। হযরত উসমান রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু রক্তাক্ত অবস্থায় কুরআন মজীদের ওপর মুখথুবড়ে পড়ে যান। তার পবিত্র রক্তের ফোঁটায় সুরা বাকারার ১৩৭ নম্বর আয়াতে কারিমার অংশ বিশেষ রক্তে লাল হয়ে যায়। রক্তে লাল হয়ে যাওয়া অংশটি হচ্ছে ফাসারাকফিকা হুমুল্লাহু ওয়া হুয়াস, সামিউল আলীম এবং তাদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট আর তিনি সব শোনেন সব জানেন। এই সময় আরও কয়েকজন সেই হামলায় শহীদ হন। সেই রক্তাক্ত কুরআন মজীদ আজও তাসখন্দ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। হযরত ঊসমান (রাদি.) এর হত্যাকারী সন্ত্রাসীরা জিলহজ মাস বেছে নেয় এ জন্য যে, এই সময় অধিকাংশ সাহাবী হজ করতে মক্কা গমন করেন। হযরত উসমান রাদি আল্লাহ তায়ালা আনহু শহীদ হন হিজরী ৩৫ সনের ১৮ জিলহজ মুতাবিক ৬৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুন। সন্ত্রাসীরা কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠার কথা বলে লোক জড়ো করে কুরআন তিলাওয়াতরত হযরত উসমান রাদি আল্লাহু তায়ালাকে হত্যা করে প্রমাণা করল তাদের মুখে কুরআনের আইনের কথাটা দিল ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক নবীরই একজন বিশেষ সহচর (রফীক) থাকে। জান্নাতে আমার সহচর হবে উসমান (তিরমিযী শরীফ)। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু কুফার মসজিদে ফজরের সালাতে ইমামতি করা অবস্থায় আবদুর রহমান নামের এক খায়েজি সদস্যের তলোয়ারের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। এই খায়েজিরা নিজেদের দলকে সত্যিকার ইসলামী জামাত বলত। এই সন্ত্রাসী দল হযরত আলী করমাল্লাহ, হযরত মু’আবিয়া রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আমর ইবনুর আস রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুর বিরুদ্ধে কাফির যাওয়া দেয়। তাদের সেøাগান ছিল লা হুকমা ইন্নালিল্লাহু আল্লাহর আইন ছাড়া কোন আইন মানি না। হযরত আলীকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সালাম বলেছিলেন তোমাকে কেবল মুমিনই ভালবাসবে আর মুনাফিককে তোমার প্রতি বিশেষ শোষণ করবে (তিরমিযী শরীফ) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের এই ভবিষ্যদ্বাণী বর্ণে বর্ণে সত্যে পরিণত হলো। মুসলিম নামধারী মুনাফি খারিজী সম্প্রদায় হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজ হাহুকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি মুতাবিক ৪০ হিজরীর ১৬ রমাদান শুক্রবার ফজরের সালাতরত অবস্থায় তরবারি দিয়ে আঘাত করল, তার কয়েকদিন পর তিনি শহীদ হলেন। উল্লেখ্য, খারিজীর ওই একই তারিখে একই সময়ে মু’আবিয়া রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুর হত্যার জন্য চারক নামক এক গুপ্তঘাতকে দামেস্কে পাঠান এক ইবনে বাবার নামের এক গুপ্তঘাতককে পাঠায় ফুসতাতে হযরত আমর ইবনুল তাসকে (রাদি.)-কে হত্যার জন্য। দামেস্কের মসজিদে হযরত মুতাবিয়া (রাদি.) গুপ্তঘাতকের তরবারির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং মুসতাতের মসজিদে ওই দিন হযরত আমর ইবনুল আস (রাদি.) অসুখ থাকায় খারিজা ইবনে সাবি হাবিবা ফজরের সালাত পড়াচ্ছিলেন। ভুলক্রমে তাকেই আমর (রা) মনে করে গুপ্তঘাতক তরবারির আঘাতে হত্যা করে। এই খারিজী বা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত দলটির প্রেতাত্মারা কারবালায় ইমাম হুসাইন আলায়হিস সালামসহ প্রায় ৭০ জনকে হত্যা করে। তাদের ছায়া বিভিন্ন যুগে কালো হাত বিস্তার করে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালিয়ে ইসলামবিরোধী অপশক্তির স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েছে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×