বিশেষ প্রতিনিধি ॥ জেলহত্যা দিবসের আলোচনায় আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কয়েক শীর্ষ নেতা-মন্ত্রী বলেছেন, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পথ ধরেই ৩ নবেম্বর কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে নৃশংস-নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধ্বংস করার নীলনকশা থেকেই ইতিহাসের এই জঘন্য হত্যাকা-। তবে ক্ষমতা ও মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কীভাবে মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়-চার নেতা ঐতিহাসিক ও রাজনীতিতে শিক্ষণীয় সেই দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
‘শহীদ এম মনসুর আলী স্মৃতি সংসদ’-এর উদ্যোগে বুধবার রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ-আইডিইবি মিলনায়তনে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও শহীদ এম মনসুর আলীর সন্তান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বক্তব্য রাখেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এমপি, গণতন্ত্রী পার্টির ডা. শাহাদাৎ হোসেন, আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম ঠান্ডু, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান প্রমুখ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু চার নেতাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে চার নেতার নেতৃত্বেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি। খুনীরা মনে করেছিল চার নেতাকে শেষ করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সেই খায়েস পূরণ হয়নি। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে এই দেশে আজ বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার আদর্শ বাস্তবায়ন হচ্ছে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক সূচকে আমরা আজ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছি। এই অগ্রযাত্রাকে বানচাল করতে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। দেশ সঠিক পথে এগিয়ে চলছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই চার নেতার আত্মত্যাগ সার্থক হবে।
কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ৩ নবেম্বর ছিল ১৫ আগস্টের এক্সটেনশন। কারণ খুনীরা জানত, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এই চার নেতাই তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও জনগণকে আবার সংগঠিত করতে পারতেন। সেজন্য এই হত্যাকা- ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত। তিনি বলেন, এখানে জিয়াউর রহমানের নাম যেমন আসছে, তেমনি খুনিী মোশতাকের নামও আসে। এই দু’জনের সম্মলিত সিদ্ধান্তেই চার নেতাকে হত্যা করা হয়। খুনীরা কী পরিমাণ নির্মম, নিষ্ঠুর ও মনুষ্যত্বহীন ছিল তা তাদের কাজ দেখেই বোঝা যায়। মনুষ্যত্বের বদলে তাদের মধ্যে ছিল শুধু জিঘাংসা। ১৫ আগস্টেও তারা অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী থেকে শুরু করে শিশু রাসেলকে একইভাবে হত্যা করে। আমরাও কারও যতবড় শত্রুই হই না কেন তার কেউ মারা গেলে বিচলিত হই, কিন্তু খুনীরা বিচলিত হয়নি, তারা ঠা-া মাথায় খুন করে।
সভাপতির বক্তব্যে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সহচর ছিলেন যেই চার নেতা তারা মরণেও তাঁর সহচর হয়েছিলেন। তাঁরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন সবাই মোশতাক বা জিয়া নয়, সব বাঙালী বেইমান নয়। আমাকে যখন বলা হয়- মনসুর আলীর সন্তান, তখন অনেক ব্যথা-বেদনা অনুভব করি। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন যেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন, সেই কারাগারে চার নেতাকে হত্যা করা হয়। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সময় আমিও বহুবার ওই জেলখানায় বন্দী ছিলাম। তিনি বলেন, বন্দী অবস্থায় চার নেতাকে হত্যা করতে খুনীরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। আরও অনেক নেতাই সেদিন জেলখানায় ছিলেন, কিন্তু খুনীরা বেছে বেছে ওই চারজনকেই হত্যা করে। কারণ খুনীরা জানত-এই চারজনের একজনও যদি বেঁচে থাকেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা আবার সংগঠিত হয়ে যাবে।
ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, চার নেতার মৃত্যু কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। এটা একটি বিশ্বাস, আদর্শ ও নেতার প্রতি আনুগত্যের মৃত্যু। তাঁরা ছিলেন নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, জিয়াউর রহমান ১৫ আগস্ট ও ৩ নবেম্বরের খুনীদের রক্ষার নীতি গ্রহণ করেন। সেজন্য একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, চার নেতার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে আলোচনা করতে নয়, এখানে এসেছি প্রাণের টানে। তাদের যেই রাজনীতি, কালের বিবর্তনে আজ সেই রাজনীতিতে অনেক বিবর্তন ঘটেছে।
জিয়ার নির্দেশেই জেল হত্যাকা-- ড. হাছান ॥ আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বাঙালী জাতির জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতার হত্যা। পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এমন জঘন্য নারকীয় হত্যাকা ঘটেনি। জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই এই ঘটনা ঘটেছিল। জিয়া ও তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করেছিলেন।
বুধবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে শিখা চিরন্তনে জাতীয় চার নেতার স্মরণে প্রদীপ প্রজ্ব¡লন অনুষ্ঠানে তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর চার সহচর তাঁদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন, তাঁরা অন্যায়ের সঙ্গে কোন আপোস করেননি। এই দেশ যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন তাদের এই আত্মত্যাগ দেশপ্রেমিক জনগণের কাছে প্রেরণার উৎস ও পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।