ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর বলছে ইতিহাস

দেশপ্রেম ও নেতার প্রতি আনুগত্য, অনন্য নজির

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ৩ নভেম্বর ২০১৬

দেশপ্রেম ও নেতার প্রতি আনুগত্য, অনন্য নজির

মোরসালিন মিজান ॥ জাতির জনকের বুক থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সেই রক্তনদী পায়ে মারিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসে গেছেন খন্দকার মুশতাক। সেনা নৌ বিমান বাহিনীর প্রধানরা অস্ত্র ফেলে হাতভর্তি করে চুরি পরেছে। রেডিওতে গিয়ে ঘাতকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ঘোষণা দিচ্ছে নির্লজ্জ কাপুরুষের দল। মুখোশগুলো এভাবে যখন একে একে খসে পরছে তখন জাতীয় চার নেতা দাঁড়ান চারটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে। এসব প্রাচীরে মাথা ঠুকেও কাজ আদায় করতে পারে না ষড়যন্ত্রকারীরা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানের মুজিব প্রেম-নীতি-আদর্শ ভিত কাঁপিয়ে দেয় জাতীয় বেঈমানদের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এর ঠিক আড়াই মাস পর ৩ নবেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় খুন করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। এর পর বহুকাল গত হয়েছে। যে কক্ষে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল নেতাদের, সেখানে এখন জাদুঘর। বেদনাবিধুর ইতিহাস গুমরে কাঁদছে। দেশের জন্য আত্মত্যাগ এবং ‘মুজিব ভাইয়ের’ প্রতি আনুগত্যের বিরল দৃষ্টান্ত বুকে দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর। উদ্বোধন করা হয়েছিল ২০১০ সালের ৮ মে। কিন্তু কারাগারের একেবারেই অভ্যন্তরে হওয়ায় জাদুঘরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর হলে জাদুঘরটি পরিদর্শনের সুযোগ পান সাধারণ মানুষ। বুধবার ছিল প্রথম দিন। এদিন মানুষের ঢল নামে পুরনো কারাগার এলাকায়। মূল প্রবেশপথ ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলে হাতের বাঁ পাশে একটি সরু রাস্তা। এই রাস্তা ধরে সামান্য এগিয়ে গেলেই জাতীয় চার নেতা কারা স্মৃতি জাদুঘর। যতদূর তথ্য, ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল মিনি সিনেমা হল। নাম ছিল শকুন্তলা। পরবর্তিতে নিউ জেল নামে পরিচিতি পায়। তিনটি বড় বড় কক্ষ নিয়ে নিউ জেল। সাদা চোখে দেখলে মনে হতে পারে নতুন ভবন। আদতে, রং করা। যতটা সম্ভব সুন্দর করা হয়েছে। এর পরও বেদনার রং ঢাকা যায় না। একতলা ভবনের সামনে দাঁড়াতেই মন শোকগ্রস্ত হয়ে ওঠে। বর্বর হত্যাকা-টি সংঘটিত হয় প্রথম কক্ষে। এখানে চার নেতাকে একত্রিত করে ব্রাশফায়ার করে খুনী চক্র। বীরেরা মরে না। শহীদস্মৃতি কক্ষটির নাম তাই ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বারান্দা থেকে দেখতে হয়। প্রথমেই চোখে পড়ে একটি নামফলক। ফলকের ইটগুলো রক্তের মতো লাল। মূল অংশে শেতপাথরে লেখা চার মৃত্যুঞ্জয়ীর নাম এবং সংক্ষিপ্ত পরিচয়। ফলক থেকে চোখ তুলে সামনে তাকালে লোহার গ্রিল। বাইরে দাঁড়িয়ে গুলি ছুড়েছিল বিপথগামীরা। কতটা বিদীর্ণ হয়েছিল বুক, সে প্রমাণ এখনও দিচ্ছে লোহার শিকগুলো। একাধিক শিকে খোঁড়লের সৃষ্টি হয়েছে। লাল রং দিয়ে খোঁড়লগুলো চিহ্নিত করা। দেখে গা শিউরে ওঠে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কক্ষের অভ্যন্তরে চোখ রাখলে দেখা যায় একটি ছোট চৌকি। এত ছোট যে, শোয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। গ্লাস শোকেসে রাখা চৌকির পাশে একটি হাতাওয়ালা চেয়ার। ছোট্ট টেবিল। কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই কক্ষে থাকতেন দেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তাদের কোন একজনের ব্যবহৃত চৌকি চেয়ার টেবিল প্রদর্শিত হচ্ছে কক্ষের ভেতরে। দ্বিতীয় কক্ষটিও দেখতে প্রায় অভিন্ন। একই রকম, চৌকি ও টেবিল চেয়ার পাতা। জানা যায়, এখানে রাখা হয়েছিল একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা এম মনসুর আলীকে। তৃতীয় কক্ষে ছিলেন এএইচএম কামারুজ্জামান। তার ব্যবহৃত চৌকি এবং টেবিল চেয়ারটিও কলঙ্কজনক ইতিহাসের স্মারক হয়ে আছে। তবে দর্শনার্থীর জানার আগ্রহ থাকলেও জাদুঘরের কোথাও জেল হত্যার ইতিহাসটি উল্লেখ করা হয়নি। বর্ণনা করার কেউ তেমন নেই। যে যার মতো করে বলছেন। এ অবস্থায় কালরাতের কথা জানতে শরণাপন্ন হতে হয় সাইদুর রহমান প্যাটেলের। তৃতীয় কক্ষটিতে একই সময় বন্দী ছিলেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। এখন বয়স অনেক। কিন্তু দুঃসহ স্মৃতি ভুলেননি। জনকণ্ঠকে তিনি জানান, প্রথম কক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন না শুধু। মোট ৮ নেতাকর্মীকে রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় কক্ষে ছিলেন ৯ থেকে ১০ জনের মতো রাজবন্দী। তৃতীয় কক্ষে সবচেয়ে বেশি ১৭ জন। তিন কক্ষে অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন, নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা, ঢাকার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাশিম উদ্দীন হায়দার পাহাড়ী, সংসদ সদস্য আজহার ও শামীম মিসির। প্যাটেল বলেন, খুনী ডালিমসহ কয়েকজন আগেই রেকি করে গিয়েছিল নিউ জেল। আমরা তখন থেকেই শঙ্কা করছিলাম। হত্যাকা-ের রাতটা ভয়ঙ্কর এবং বিভীষিকাময় ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, রাত ৩টা ১৭ মিনিটে পাগলা ঘণ্টি বেজে ওঠে। একটি কাঁসার ঘণ্টি ছিল, সেটি বাজতে থাকে। কারারক্ষীরাও অনবরত হুইসেল বাজাতে থাকে। এভাবে আতঙ্ক সৃষ্টির এক পর্যায়ে চার জাতীয় নেতাকে প্রথম কক্ষটিতে একত্রিত করা হয়। এক পর্যায়ে কানে আসতে থাকে গুলির শব্দ। তখনই অনুমান করেছিলাম, সব শেষ। ভোরবেলা সামান্য আলো ফুটতেই দেখি, জেলের সামনের ড্রেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠি আমিÑ নেতারা নেই। নেতাদের মেরে ফেলা হয়েছে। আমার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে গ্রিলের কাছে আসেন। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। প্যাটেল ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর কক্ষে। কাছ থেকে নেতাকে দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, হত্যা করার কিছুক্ষণ আগে কারারক্ষীরা তাকে নিয়ে যায়। হাফহাতা হাল্কা গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবি পরে তিনি বের হয়ে যান তাদের সঙ্গে। আমি তখন বলেছিলাম, লিডার, ওরা বোধহয় কোন কাগজপত্রে সাইনটাইন করাতে চাইবে। কিন্তু মনসুর আলী মৃত্যু নিশ্চিত জানতেন বলেই মনে হয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গেও কথা হয় প্যাটেলের। নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, হত্যার আগের রাতে তাজউদ্দীন আহমদ স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুকে দেখেন। বঙ্গবন্ধু তাকে টুঙ্গিপারায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন বলে জানান। দুঃস্বপ্নই সত্য হয় মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর। ঘাতকদের নির্মমতার বর্ণনা দিয়ে প্যাটেল বলেন, এম মনসুর আলী তখনও শহীদ হননি। পান করার জন্য পানি চাচ্ছিলেন। কারারক্ষীরা পানি দেয়নি। বরং কেউ একজন দৌড়ে গিয়ে অস্ত্রধারীদের খবর দেয়। তারা ফিরে এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এ সময় অন্য তিন নেতার শরীরেও বেয়নেট চার্জ করা হয়। জাদুঘরের বাইরেও আছে জাতীয় চার নেতার স্মৃতিচিহ্ন। পরেরদিন তাঁদের মরদেহ যেখানে এনে জড়ো করা হয়েছিল সেখানে বেদি নির্মাণ করা হয়েছে। বোতলব্রাশ ফুল নুয়ে আছে বেদির উপরে। পাশেই আছে জাতীয় চার নেতার আবক্ষ মূর্তি। ব্রোঞ্জে গড়া ভাস্কর্য কালো মার্বেল পাথরের ওপর বসানো। দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে মাথা। মনে পড়ে যায় সেই অমর কবিতাÑ এনেছিলে সাথে করি মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান...। এই দানে উজ্জ্বল কারা স্মৃতি জাদুঘর। আজ রক্তস্রোত নেই। লাল রঙ্গন ফুটে আছে নিউ জেলের সামনে। শিউলী গাছের নিচে স্তূপ হয়ে আছে সুগন্ধী ফুল। স্তূপ? নাকি অঞ্জলি!
×