ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মন্দির ভাংচুরের ঘটনায় দুটি পৃথক মামলা

নাসিরনগরে আতঙ্ক কাটেনি, রাস্তায় বিজিবি টহল দিচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১ নভেম্বর ২০১৬

নাসিরনগরে আতঙ্ক কাটেনি, রাস্তায় বিজিবি টহল দিচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার, নাসিরনগর থেকে ফিরে ॥ ভীত সন্ত্রস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে নাসিরনগরের গ্রামগুলো। রবিবার দিনভর তা-বের পর সোমবার উপজেলা সদরে উদ্বেগ আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সাধারণ মানুষের আনাগোনাও কমে গেছে বাজারগুলোতে। জেঠাগ্রাম, নূরপুর, নরহা, হরিণবেড়, দত্তপাড়া, ফার্মগেট বাজার এলাকার দোকানপাট সোমবার দুপুরের দিকেও বন্ধ দেখা গেছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে স্থানীয়রা জানান, রবিবার হামলার পর আতঙ্ক থেকেই দোকানপাট তেমন খুলছে না ব্যবসায়ীরা। আতঙ্কে উদ্বিগ্ন পরিবারের কর্তারা পরিবারের লোকজনকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছে। তবে পুলিশ বলছে, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ক্রমশই স্বাভাবিক হয়ে আসছে নাসিরনগরের জনজীবন। রবিবার মন্দির ভাংচুরের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। অন্য দিকে পুরো ঘটনা তদন্তে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন পৃথক ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সোমবার বিকেলে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাসিরনগরে শান্তি সম্প্রীতি সমাবেশ হয়। এতে মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাংচুরকারীদের বিচার দাবি করা হয়। পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। গৌর মন্দিরের ভাংচুরের ঘটনায় সাধারণ সম্পাদক নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে ১০০০/১২০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। দত্তবাড়ির দুর্গা প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনায়ও কাজল জ্যোতি দত্ত মামলা দায়ের করেন। এ মামলায়ও আসামি করা হয় ১০০০/১২০০জনকে। পুলিশ জানিয়েছে, এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৮জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত রবিবার রাতে ৬ জন এবং সোমবার সকালে ২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে হামলায় অংশগ্রহণকারীদের নাম ঠিকানা জেনে তাদেরও মামলায় আসামি করা হবে। তবে দু’টি মামলাতে অজ্ঞাত লোকদের আসামি করা হয়েছে। দত্তবাড়ির কমলা দত্ত জানান, আমরা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছি। হামলার সময় শিশুরা ভয়ে চিৎকার করছিল। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমরা তো অপরাধ করিনি। যে অপরাধ করেছে তার বিচার হোক। আমরা এর বিচার চাই। গীতা দাস জানান, হামলার পর থেকে আতঙ্কিত অবস্থায় আছি। কখন যে কি হয়? এদিকে সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপসারন দাবি করেছে জেলা আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে নাসিরনগরের পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও সংখ্যালঘুদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। সোমবারও পুলিশের পাশাপাশি বিজিবির সদস্যদেরও রাস্তায় টহল দিতে দেখা গেছে। নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের জানান, দু’টি মামলাতেই বাদী পক্ষ অজ্ঞাতদের আসামি করেছে। তবে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে নাম-ধাম সংগ্রহ করে হামলাকারীদের শনাক্ত করে আসামি করা হবে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে। এদিকে সোমবার বিকেলে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জেম আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শান্তি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মোঃ রেজওয়ানুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম, নাসিরনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ.টি.এম মনিরুজ্জামান সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জন কুমার দেব, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হামিদা লতিফ পান্না। শান্তি সমাবেশে বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। এদিকে নাসিরনগরে নৃশংস ঘটনায় এখন পর্যন্ত জেলার সুশীল সমাজ মুখ খোলেনি। কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে অসহায় সংখ্যালঘুরে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এ নিয়ে সচেতন মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে পবিত্র কাবা শরীফকে অবমাননা করে আপত্তির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরও একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে গত রবিবার নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন মন্দির ও বাড়িঘরে ভাংচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি সামাজিক শান্তি ও ধর্মীয় চেতনা রক্ষা এবং নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টিকারীদের অপতৎপরতা প্রতিহত করতে প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ এবং নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল কাদেরের দ্রুত অপসারণ দাবি করে জেলা আওয়ামী লীগ। রবিবার রাতে স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মহিউদ্দিন খান খোকন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই দাবি করা হয়। পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান জানান, নাসিরনগরে সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আমরা সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ করে জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছি। নাসিরনগরের ঘটনায় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ৩ (তিন) সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে অতিরিক্ত ইকবাল হোসাইনকে প্রধান করা হয়। কমিটিকে ৩ কার্য দিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান জানান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। ১০ (দশ) কর্ম দিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেছেন, আমি এ ঘটনায় মর্মাহত। যারা অপরাধী তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা এবং উস্কানীই এর জন্য দায়ী। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার নাসিরনগর উপজেলা হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাস (৩০) পবিত্র কাবা শরীফ অবমাননা করে মহাদেবের মূর্তি কাবা শরীফের উপর বাসিয়ে ফেজ বুকে পেস্ট করে। আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে। এ ঘটনায় শনিবার স্থানীয় লোকজন রসরাজ দাসকে ধরে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনায় শনিবার রাতেই রসরাজের বিরুদ্ধে নাসিরনগর থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের করা হয়। রবিবার এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়। উত্তেজিত জনতা উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করে বেশ কিছু হিন্দু বাড়ি-ঘর এবং দত্তবাড়ি মন্দির, জগন্নাথ বাড়ি মন্দিরসহ ১২টি মন্দিরে হামলা ও ভাংচুর করে। হামলাকারীরা লুটতরাজও করে। খবর পেয়ে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যরা বিকেল ৩টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী যা বললেন ॥ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১ আসনের সংসদ সদস্য ও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী এ্যাডভোকেট সায়েদুল হক এমপি বলেছেন, রবিবারের ঘটনার খবর পেয়ে তিনি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। তিনি এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে সরাসরি সোমবারও কথা বলেছেন। মুঠোফোনে প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, প্রতিটি ঘটনায় পৃথক পৃথকভাবে মামলা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
×