ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

লবণ পৌঁছায় না কেন?

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

লবণ পৌঁছায় না কেন?

এম শাহজাহান ॥ দুই দফায় আড়াই লাখ টন আমদানির লবণ এখনও দেশে পৌঁছায়নি। এতে দাম কমছে না লবণের। খুচরা পর্যায়ে দ্বিগুণ দামে ভোক্তাদের অত্যাবশ্যকীয় এ পণ্যটি কিনতে হচ্ছে। প্রতি কেজি লবণ পেতে ক্রেতাদের গুণতে হচ্ছে ৩৫-৪২ টাকা। অথচ এক বছর আগেও এ লবণের দাম ছিল ১৫-২৪ টাকা। লবণের বাজার স্বাভাবিক না হওয়াসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চলতি সপ্তাহে জরুরী বৈঠক আহ্বান করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দ্রুত ভারত থেকে লবণ দেশে নিয়ে আসা এবং ঘাটতি পূরণে প্রয়োজনে আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে চাষীরা যাতে লবণের ন্যায্যমূল্য পায় সে ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, গত কোরবানি ঈদের আগে থেকে সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে অস্থির লবণের বাজার। দাম নিয়ন্ত্রণে ওই সময় সরকার দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়। এতেও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। আশা করা হচ্ছিল, আড়াই লাখ টন লবণ দেশে প্রবেশ করলে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু দীর্ঘসময়ে আমদানিকৃত ক্রুড লবণ দেশে পৌঁছায়নি। তথ্যমতে, আড়াই লাখ টনের মধ্যে মাত্র ৭০ হাজার টন লবণ দেশে আনা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া পাইপলাইনে রয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টন লবণ। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানিকৃত আড়াই লাখ টন লবণ এখনও দেশে প্রবেশ করেনি। তবে একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে দেশে আনা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দ্রুত লবণ আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। লবণের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, অত্যাবশ্যকীয় এ পণ্যটি নিয়ে কাউকে কারসাজি করতে দেয়া হবে না। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া ঘাটতি মোকাবেলায় শীঘ্রই আরও এক লাখ টন লবণ আনার অনুমতি দেয়া হবে। সব লবণ দেশে ঢুকলে পণ্যটির দাম স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তিনি বলেন, লবণসহ আরও কয়েকটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে বৈঠক ডাকা হয়েছে। আশা করছি সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম কমে আসবে। আমদানিকারকরা বলছেন, লাইটার জাহাজ সঙ্কটের কারণে মাদার ভেসেলের ভাড়া বেড়ে গেছে। এছাড়া শিপমেন্ট সময়মাত্র ৩০ দিন। এই বাস্তবতায় শিপমেন্ট সময় বাড়িয়ে ৪৫ দিন করার দাবি রয়েছে তাদের। তারা বলছেন, লবণবোঝাই মাদার ভেসেল বঙ্গোপসাগরে ভিড়েছে। কিন্তু লাইটার জাহাজের সঙ্কট থাকায় লবণ খালাস বিলম্বিত হচ্ছে। দেশে লবণের চাহিদা, উৎপাদন এবং ঘাটতির তথ্য নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি দেশে লবণের সঙ্কট রয়েছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, চাহিদার চেয়ে বেশি লবণের যোগান রয়েছে। তবে ঘাটতি থাকলে আমদানি করার অনুমতি দেবে সরকার। যদিও খোলাবাজারে লবণের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো গত এক বছরের ব্যবধানে লবণের দাম বাড়িয়েছে গড়ে ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ। রাজধানীর খুচরা দোকানগুলোতে বর্তমানে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকায়। আর খোলা লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা কেজি। গত এক বছরে কয়েক দফা বেড়েছে লবণের দাম। লবণ সংশ্লিষ্ট এক সরকারী কর্মকর্তার মতে, অপরিশোধিত লবণের আন্তর্জাতিক দর ও প্রক্রিয়াজাত খরচসহ দেশে বর্তমানে প্রতি কেজি লবণের দাম ১৫ টাকা হওয়া উচিত। কিন্তু সেই লবণ সিন্ডিকেট করে ৪০-৪২ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। লবণের দামবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) এক কর্মকর্তা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য লবণ এখন সিন্ডিকেটের কবলে চলে গেছে। তারা পরিকল্পনা করে দাম বাড়াচ্ছে। বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। বর্তমানে দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। চাহিদার তুলনায় আমদানি ও সরবরাহ দুটিই বেশি। তার পরও দাম বাড়াচ্ছেন মিল মালিকরা। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নূরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, ঘাটতি পূরণেই সরকার লবণ আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে। কিন্তু বড় ৪-৫টি সিন্ডিকেট শিল্পগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে এ শিল্প। এ কারণে সমহারে লবণ আমদানি ও বিপণনের সুযোগ দেয় সরকার। আশা করছি, ভবিষ্যতেও এ শিল্প রক্ষা ও লবণের দাম স্বাভাবিক রাখতে উদ্যোক্তাদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। বিসিক সূত্র জানায়, চলতি বছরে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৬ লাখ ৫৮ হাজার টন। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয়েছে ১৫ লাখ ৫৫ হাজার টন। ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৩ হাজার টন। কিন্তু এর বিপরীতে সরকার লবণ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে আড়াই লাখ টন। আরও এক লাখ টন আমদানির অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। ফলে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ দেড় লাখ টন বেশি। এছাড়া আগের কিছু লবণও বাজারে রয়েছে। অন্যদিকে মিল মালিক ও লবণচাষীরা বলছেন, লবণের বিষয়ে বিসিক যে তথ্য দিচ্ছে সেটি সঠিক নয়। দেশে যদি ১৬ লাখ টন লবণের চাহিদা ধরা হয় তবে ১৬ লাখ টন লবণ পরিশোধ করতে ২২ লাখ টন অপরিশোধিত লবণের প্রয়োজন। কেননা পরিশোধনের সময় লবণের অনেক অপচয় হয়। এ হিসাবে দেশে লবণের চাহিদা ২২ লাখ টন। আর এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই সরকার লবণ আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে। বিসিক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে লবণ চাষের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। নবেম্বর থেকে মে পর্যন্ত উপকূলে লবণ চাষ করা হয়। ডিসেম্বর থেকেই নতুন লবণ বাজারে আসবে। ফলে শীঘ্রই দাম কমে আসবে। লবণের দাম বাড়ানোর জন্য পাঁচ ব্যবসায়ী গ্রুপের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তা নাকচ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ভোক্তা স্বার্থে লবণের দাম আরও কমানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
×