ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইসিটি আইনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চাঞ্চল্যকর ঘটনা

ফেসবুকে ভুয়া আইডিতে আপত্তিকর স্ট্যাটাস ॥ সংসার তছনছ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

ফেসবুকে ভুয়া আইডিতে আপত্তিকর স্ট্যাটাস ॥ সংসার তছনছ

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বড় হাতিয়ার এখন ফেসবুক। ফেসবুকের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মান সম্মান নষ্ট করা, এমনকি রাজনৈতিক নোংরামি প্রচার করে ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি নষ্ট করার ঘটনা অহরহই ঘটছে। একজনের ছবি ও মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে ভুয়া আইডি খুলে তথ্য সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ এখন প্রায়ই ওঠে আসছে। এসব অপকর্ম প্রতিরোধে সরকার আইসিটি এ্যাক্ট প্রণয়ন করে। সেই আইনেই এখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ঘটনাও ফাঁস হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানী ও ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে আইসিটি এ্যাক্টে দায়ের করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর কাহিনী বেরিয়ে আসে। অনুসন্ধানে জানা যায়- রাজধানীর উত্তরায় বসে ময়মনসিংহের এক বন্ধুকে ঘায়েল করার জন্য ফেসবুকে ফেক আইডি খুলে বঙ্গবন্ধুর নামে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেয়া হয়। এতে ওই বন্ধুকে পুলিশ ধরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠায়। পরে ওই বন্ধুর স্ত্রীকে ভাগিয়ে নেয়া হয়। পুলিশ ওই ঘটনা তদন্ত করতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হয়। পরে ওই নিরীহ যুবক জেল থেকে ছাড়া পেলেও- জেলে যেতে হয়েছে মিথ্যাচারীকেও। চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের নজরে এসেছে আরও অনেক ঘটনা। মামলার সূত্রে জানা যায়, ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জের ওহিদুল ইসলাম অপু ঢাকায় আইইউবির শিক্ষার্থী। তার বন্ধু সদরের মাঝিরহাট গ্রামের খলিলুর রহমান পেশায় ব্যবসায়ী। দুই বন্ধুর পারিবারিক যোগাযোগও নিবিড়। এ সুবাদেই খলিলের স্ত্রী সাবিনার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে অপু। সেটা আঁচ করতে পেরে খলিল প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়ে বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তাতেও থামেনি অপুর গোপন প্রণয়। সে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে। খলিলের স্ত্রী সাবিনাও অপুর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য স্বামীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। দুই বন্ধু একে অপরকে দেখে নেয়ার হুমকি দিলে অপু প্রকাশ্যেই খলিলকে শায়েস্তা করার হুমকি দেয়। কিছুদিন পর দেখা যায়- খলিলের নামে ফেসবুকে একটা আইডি খুলে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামে আপত্তিকর মন্তব্যে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। এতে ময়মনসিংহ শহরজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। ক্ষুব্ধ হয়ে শহর যুবলীগের বাপ্পী নামের এক নেতা সদর থানায় আইসিটি এ্যাক্ট-এর ৫৭ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার নং ৪০(৮) ২০১৬। পুলিশ গত ১৪ আগস্ট খলিলুর রহমানকে আটক করে। এবং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু এতে খলিল বিস্ময় প্রকাশ করে বার বার বলতে থাকেন- বঙ্গবন্ধুর নামে স্ট্যাটাস তো দূরের কথা- তিনি ফেসবুকের এই আইডিই খুলেননি। ফেসবুক কি সেটাও জানেন না। তবে তার এক বন্ধু ওহিদুল ইসলাম অপু এ কাজ করতে পারে। কিছুদিন আগে সে তাকে হুমকিও দিয়েছিল। খলিলের এমন তথ্যে পুলিশেরও কিছুটা সন্দেহ দেখা দেয়। তবুও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে জেল হাজতে পাঠানো হয়। এদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ময়মনসিংহ সদর থানার দারোগা আনোয়ার হোসেন এই ফেসবুকের প্রকৃত আইডি কোথা থেকে-কে করেছে, তার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে আইটি বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা নিয়ে জানতে পারেন- এটা ভুয়া। তিনি আরও নিশ্চিত হন- খলিলের বন্ধু ওহিদুল ইসলাম অপুই এই অপকর্মের হোতা। তিনি ঢাকার উত্তরার বাসায় বসে রুমটের ফোন নম্বর দিয়ে জি-মেইল থেকে ফেসবুকের ওই আইডি তৈরি করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নামে স্ট্যাটাস দেন। পুলিশ ঢাকায় এসে গত ১৩ অক্টোবর উত্তরা থেকে আটক করে ওহিদুল ইসলাম অপু ও তার প্রতারক বন্ধু নাসিরকে। তাদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তারা স্বীকার করেন- খলিলকে শায়েস্তা করতেই ভুয়া আইডি খুলে এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এ জন্য তারা অনুতপ্ত। এ সম্পর্কে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত খলিলের স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া ফাঁস হওয়ার পর থেকেই অপু তাকে ঘায়েল করার জন্য এমন দুরভিসন্ধি আঁটে। কিছুতেই যখন খলিলকে পরাস্ত করা যাচ্ছিল না- তার স্ত্রীকে নিজের ঘরে আনা যাচ্ছিল না- তখনই ফেসবুকে নকল আইডি খুলে এ ধরনের আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেন। খলিলের কথাবার্তা ও আচরণে নিরীহ মনে হওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়- তাহলে কারা এ কাজ করতে পারে। তখন তিনি জানান, অপু এ কাজ করতে পারে। তারই সূত্র ধরে তদন্ত করতে গিয়ে খলিলের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এবং ঢাকা থেকে অপু ও প্রতারক নাসিরকে আটক করা হয়। তারা এখন জেল হাজতে। মামলার তদন্ত শেষে খুব শীঘ্রই চার্জশীট দেয়া হবে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে খলিল জনকণ্ঠকে বলেন, জীবনে কোনদিন ফেসবুক খুলিনি। মোবাইলে ঠিকমতো নাম্বারটা সেভ করতে পারি না। ফেসবুকে কি করা হয় সেটা কখনও জানার চেষ্টাও করিনি। দোকানে ওষুধ বিক্রি করেছি- আর ভাত খেয়েছি। এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে সুখেই ছিলাম। হঠাৎ অপু আমার নামে ফেসবুকে বঙ্গবন্ধুর নামে কি খারাপ লিখল আর পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। পুলিশ যখন বুঝল- আমি নির্দোষ, তখন অপুকে ধরল ঠিকই। কিন্তু মাঝখানে আমি জেল খাটলাম দেড়মাস। চলতি বছরের ১৪ আগস্ট জেলে যাই, ২৮ সেপ্টেম্বর বের হই। খলিল বলেন, জেল থেকে বের হওয়ার দু’দিন পর অপু আমাকে মোবাইল ফোনে মেসেজ দিয়ে জানায় আমার স্ত্রী সাবিনা এখন তার ঘরণী। সে নাকি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। ডিভোর্স লেটারও সে মোবাইলে আমাকে পাঠিয়েছে। এই অপু শুধু আমার সাজানো সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ করেনি। সে শুধু আমাকেই নয়, আরও অনেক নীরিহ ও নামীদামী ব্যক্তি ও রাজনীতিকের নামে ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে। আমার ভাগিনা আসাদকেও একই কায়দায় ঘায়েল করার জন্য মিথ্যাচার করেছে। ময়মনসিংহ শহর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্তর বিরুদ্ধেও ফেসবুকে আপত্তিকর বক্তব্য দিয়েছে। এসব ঘটনার তদন্ত ও বিচার না হলে আমার মতো নিরীহরা আরও ভুগবে। তথ্য-প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারায় শুধু খলিলের মতো নিরীহ লোকই নয় অনেকেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। টাঙ্গাইলের এক ঘটনায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে নবম শ্রেণীর ছাত্রকে দুই বছরের কারাদ- প্রদান করেন একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ঘটনায় মিডিয়াতে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায় প্রদানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও থানা পুলিশকে আদালতে তলব করে। একই সঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত স্কুলছাত্রেরও বক্তব্য রেকর্ড করে। দুই পক্ষের শুনানির পর আদালত ওই ছাত্রকে বেকসুর খালাস প্রদান করেন। এবং মোবাইল কোর্টের জুরিসডিকশন সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দেন। এ সম্পর্কে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কিছুটা সতর্ক ও কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, দেশে এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে। সব নজরে আসছে না, থানায় রিপোর্ট হচ্ছে না। এর অপব্যবহার থেকে রেহাই পেতে হলে শুধু তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্র্তাকে সতর্ক ও সংযত হলেই চলবে না। ফেসবুক যারা ব্যবহার করছেন, তাদের কৌশলী ও দক্ষ হতে হবে। কারণ ফেসবুক ব্যবহার করেন না এমন শিক্ষিত মানুষ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। ফেসবুক প্রোফাইলে ব্যক্তিগত তথ্য ছাড়াও থাকে নিজের ও প্রিয়জনদের ছবি। বন্ধুর ছদ্মবেশে কেউ যদি আপনার প্রোফাইলে ঢুকে পড়ে, তাহলে সেই তথ্য এবং ছবি ব্যবহার করে আপনাকে হেনস্থার মুখে ফেলে দিতেই পারে। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠতে পারে- কী করে চিনে নেবেন ‘ভুয়া প্রোফাইল’-দের? সেলেব্রিটির ছবি ব্যবহার ॥ ভুয়া প্রোফাইলে কোন সেলেব্রিটি কিংবা নানা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি ব্যবহার করা হয়। কখনও আবার ব্যবহার করা হয়, নানা মজাদার উদ্ধৃতি। যে সব প্রোফাইলের প্রোফাইল পিকচার এ্যালবামে কোন নিজস্ব ছবি থাকে না, সেগুলোকে সন্দেহের চোখে দেখা যেতেই পারে। এ্যাবাউটে ঢুকেন ॥ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসলে প্রোফাইল মালিকের এ্যাবাউটে ঢুকে দেখে নিন- তার স্কুল, কলেজ কিংবা অফিসের নাম আছে কিনা। ফেক প্রোফাইলের মালিকরা সাধারণত এসব তথ্য এড়িয়ে যায়। খেয়াল করতে হবে-সন্দেহভাজন প্রোফাইলের মালিকের সঙ্গে তার সহপাঠী বা সহকর্মীদের কোন ছবি আছে কি না। টাইমলাইনের পোস্টগুলো দেখুন ॥ টাইমলাইনে গিয়ে পোস্টগুলো খেয়াল করতে পারেন। দেখুন তাতে কারা কমেন্ট করছেন, সেটাও লক্ষ্য রাখুন। তাদের প্রোফাইল কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটাও যাচাই করে নিন। তাদের সঙ্গে প্রোফাইলের মালিকের কেমন সম্পর্ক বা তারা কী সুবাদে একে অপরকে চেনেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। এসপিএম ফাইটার ফেসবুক পেজ ॥ যদি দেখেন সন্দেহভাজন প্রোফাইলটির প্রোফাইল পিকচার কোন তারকার নয়, অন্য কোন সাধারণ ব্যক্তির, তাহলে শরণাপন্ন হতে পারেন এই পেজের। সেখানে গিয়ে প্রোফাইলটি রিপোর্ট করুন। গুগল ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ॥ সাহায্য নিতে পারেন গুগল ইমেজ সার্চের। সন্দেহভাজন প্রোফাইলের প্রোফাইল পিকচারটি ডাউনলোড করে গুগল সার্চ করতে পারেন। যদি অন্য কারও সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে তৎক্ষণাৎ বন্ধুত্বের অনুরোধ নাকচ করুন।
×