ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিয়ামত হোসেন

চক্ষু মেলিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৮ অক্টোবর ২০১৬

চক্ষু মেলিয়া

তোতা কাহিনী স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ শহরের বিভিন্ন এলাকায় লোকজন পাখির জ্বালায় তিতি বিরক্ত। দু’চারটে পাখি নয়, দু’চার ধরনেরও নয়। বহু পাখি। বহু ধরনের পাখি। বিশেষ করে অনেক এলাকার মানুষ বিরক্ত হচ্ছেন তোতা পাখির জ্বালায়। ‘আতা গাছে তোতা পাখি/ ডালিম গাছে মৌ/ এত ডাকি তবু কথা কয়না কেন বউ।’ কবিতার তোতা বড্ড মিষ্টি স্বভাবের, কিন্তু মাদ্রিদের তোতারা সারাদিন করে ক্যাঁচর-ম্যাচর, ওড়াউড়ি, ছোটাছুটি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি, অন্য পাখিদের দেখলেও চলে সরবে আক্রমণ। আক্রমণের প্রধান কারণ, খাবার লুট করা। চড়ুই, শালিক বা অন্য কোন জাতের পাখিরা কোথাও খাবার খুঁজে পেয়ে যেই কয়েকজনে মিলে খেতে যাবে, ওমনি তাদের ওপর ডাকাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তোতারা। ওদের ভাগিয়ে দিয়ে সাবাড় করে ফেলল ওদের খাবার! এমনই পেটুক আর হা-ভাতে পাখি ওরা! এত পাখি এলো কোত্থেকে? খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। শহরের কয়েকটি বাড়িতে শখ করে খাঁচায় তোতা পুষছিলেন কয়েকজন। কারও কারও খাঁচা থেকে উড়ে পালিয়ে যায় তোতা। কয়েকজন খাঁচা থেকে পোষা তোতাদের ছেড়েও দেন। তারপর শহরের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে ওরা। মাত্র কয়েক দশকে ওদের সংখ্যা এমন বেড়েছে যা নগরবাসীর জন্য হয়ে উঠেছে উদ্বেগজনক, বিরক্তি কর। সারাদিন একেক এলাকাজুড়ে ট্যাঁ-ট্যাঁ, কাঁচ ক্যাঁচ! অর্থাৎ বিকট আওয়াজ, শ্রুতিকটু চেঁচামেচি! এখন ওদের সংখ্যা কত তা গুনে শেষ করা যায় না! পাখিদের গোনা না গেলেও কোন কোন পাখিকে নিয়ে পাখিশুমারি যে হয় সে কথা শোনা গেছে! দু’চারটে পাখির বেলায় কথাটা সত্যি। কিন্তু যদি বলা হয়- দেশে কতগুলো কাক আছে সেটা গোনা দরকার। কিন্তু তা কি কখনও সম্ভব? এ প্রসঙ্গে সম্রাট আকবরের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করা যায়। সম্রাট বেরিয়েছেন দিল্লী শহর ভ্রমণে। সঙ্গে তার প্রিয় সভাসদ বীরবল। বাদশা হঠাৎ বীরবলকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতে পারবেন দিল্লী শহরে কয়টি কাক রয়েছে। বীরবল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, দিল্লীতে কাক রয়েছে এত লাখ এত হাজার এত শত এতটি। বীরবল অবশ্য নির্দিষ্ট একটি সংখ্যা দিয়েই কথাটা বলেছিলেন। সেই সঙ্গে বলেছিলেন সম্রাট যদি ইচ্ছা করেন গুনে দেখতে পারেন, যদি দেখেন যে কাকের সংখ্যা কম হয় তাহলে বুঝবেন কয়েকটি কাক কোথায়ও বেড়াতে গেছে। আর যদি দেখেন আমার বলার হিসাবের বাইরে কিছু কাক বেশি রয়েছে তা হলে বুঝবেন ওই বেশি কাকগুলো অন্য জায়গা থেকে দিল্লীতে বেড়াতে এসেছে! সম্রাট খুব খুশি বীরবলের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে। ঢাকা নগরীতে কয়টি কাক আছে বলা সম্ভব নয়। তবে বহু কাক আছে বলে রক্ষা! শকুন তো প্রায় বিলুপ্ত। চিল এখনও দু’চারটা হয়ত রয়েছে। কাক দিব্যি রয়েছে হাবিজাবি ময়লা-আবর্জনা খেয়ে। এসব পাখি হচ্ছে প্রাকৃতিক ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারকারী। অনেক আগে দেখা যেত রঙিন পাতি কাক। সেটা এখন বিলুপ্ত। এখন দাঁড় কাকের সংখ্যাও গেছে কমে। কদাচিৎ দেখা যায়! সেই কর্কশ কণ্ঠ কচু কুচে কালো ভুশু-ির দ-বায়স কুলের অবস্থা এখন বিপন্ন প্রায়! আমাদের অন্যান্য পাখিও অনেক কমে গেছে। একদিকে গাছ কম, অন্যদিকে দেখলেই মারার চেষ্টা। শীতকাল আসছে। খালে বিলে আসবে শীতের যাযাবর পাখি। কত লোকের নিশপিশ করবে হাত ওদের ধরার জন্য বা মারার জন্য। মারতে পারলেই তো হোটেলে দামী রোস্ট হয়ে যাবে। এর বিপরীতে দেশে এখনও দু’চার জন মানুষ আছেন যারা পাখির জন্য আশ্রয় করে দেন। তাদের বাসা তৈরি করার জন্য গাছে গাছে মাটির কলসি বেঁধে দেন। পাখিদের একটু ভালবাসলে, ওদের স্নেহ করলে ওরা নির্ভয়ে শুধু গাছে গাছেই নয় আমাদের পাশে এসে বসবে। এমন উদাহরণ অনেক দেশে রয়েছে আমাদের এটাই করা উচিত। মাদ্রিদের লোকেরা পাখির উপদ্রব সহ্য করে তাদের ভালবাসে বলে সেখানে তোতাদের পাশাপাশি দূরের অনেক দেশ থেকে দলে দলে এসে মাদ্রিদে ও অন্যান্য শহরে-গ্রামে এসেছে অনেক পাখি। এসে বাসা বেঁধেছে নির্ভয়ে। তাদের কারও বাসা গাছে কারও বাসা মাটিতে। এমন এমন পাখিও সেখানে বাসা বেঁধেছে মাটিতে, যেসব বাসার একেকটির ওজন ৫০ কেজির মতো। এই উপমহাদেশে পাখি মারার চল যে দীর্ঘকালের পৌরাণিক কাহিনীতে গল্পে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেই যাকে ‘কবিগুরু’ বলে আখ্যায়িত করে তাকে নিয়ে লেখা এক কবিতায় বলেছেন ‘নমি আমি কবিগুরু তব পদাম্বুজে...’ সেই কবি বাল্মিকীর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে। কাহিনীতে আছে, বাল্মিকী একদিন বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎ দেখলেন একটি গাছে দুটি পাখি বসে আছে। এক ব্যাধ তীর ছুড়ে একটাকে মেরে ফেলল। পাখিটি পড়ে গেল। অন্য পাখিটি তার সঙ্গীর জন্য শোক কাতর হয়ে বিলাপ করতে লাগল, এই দেখে বাল্মিকীর মন আপ্লুত হয়ে গেল দুঃখে-বেদনায়। তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল একটি কবিতার লাইন ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ’। ইত্যাদি। বলা হয় এটাই নাকি আদি কবিতা। পাখি শিকার করলে ব্যাধদের যে আনন্দ হয় তা তার একার। কিন্তু শিকার না করে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারলে তাতে আনন্দ হয় কোটি কোটি মানুষের।
×