ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোকসানা বেগম;###;বেদনা আর গর্বের চট্টগ্রাম টেস্ট

কাছে গিয়েও দূরে সরে যাওয়ার বেদনা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৬ অক্টোবর ২০১৬

কাছে গিয়েও দূরে সরে যাওয়ার বেদনা

পাস মার্ক তুলতে ৩৩ নম্বর লাগে। বাংলাদেশের সামনে চট্টগ্রাম টেস্টের শেষদিনে পাস করতে সেই নম্বরই (পড়ুন-৩৩ রান) লাগত। পরীক্ষা ছিল ইংলিশে (পড়ুন-ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল)। কিন্তু সেই পাস মার্কই তুলে নেয়া যায়নি। ২২ নম্বর কম পেয়ে ফেলই হয়েছে বাংলাদেশের। ২২ রানে হেরে গেছে। আর এত কাছে গিয়েও দূরে সরে যাওয়ার বেদনা গায়ে মিশে গেছে। সেই সঙ্গে অবশ্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যে দুর্দান্ত খেলেছে বাংলাদেশ, সমানে সমানে লড়াই করেছে; এর জন্য গর্বও হচ্ছে সঙ্গী। সেই গর্বে সবচেয়ে বড় নামটি আবার সাব্বির রহমান রুম্মনের। অভিষেক টেস্টেই জয়ের ‘বীর’ হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না। তা বললে অবশ্য ভুলও হয়। আসলে সেই সুযোগটিইতো পেলেন না সাব্বির। পঞ্চমদিনে জিততে ৩৩ রান দরকার ছিল। হাতে ছিল ২ উইকেট। সাব্বির ৫৯ ও তাইজুল ইসলাম ১১ রানে অপরাজিত ছিলেন। সঙ্গে শফিউল ইসলামের উইকেটটিও ছিল। কিন্তু যখন জিততে ২৩ রানের দরকার, এমন সময়েই বিপত্তি ঘটে যায়। ৮২তম ওভারে প্রথম তিন বলেই তাইজুল ও শফিউল আউট হয়ে যান। ননস্ট্রাইকে থেকে সাব্বির শুধু পরপর দুই উইকেট পড়ে যেতে দেখেন। সে কী কষ্ট! সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হাঁটু গেড়ে ব্যাটের হাতল মাথায় ঠেকিয়ে বসেই থাকেন। উৎসব বাদ দিয়ে তাকে সান্ত¡না দেন আবার ইংলিশ ক্রিকেটাররাই। এ দৃশ্যই বুঝিয়ে দেয়, আসলে টেস্টটি কতটা মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে। কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। কতটা রোমাঞ্চকর হয়েছে। সেই রোমাঞ্চের শেষটা ইংল্যান্ডের কপালেই জুটে। স্টোকসই সেই রোমাঞ্চের ইতি ঘটান। প্রথম ইনিংসে ২৯৩ রান করেছিল ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিল ২৪০ রান। আর প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ ২৪৮ রান করায় জিততে মুশফিকবাহিনীর সামনে ২৮৬ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। চতুর্থদিন শেষে ৮ উইকেটে ২৫৩ রান করে বাংলাদেশ। জিততে তাই ২ উইকেটে ৩৩ রান লাগে। হাতে থাকে পুরো একটি দিন। জয়ের আশায় ছিল বাংলাদেশ। সবারই জানা ছিল, একঘণ্টার মধ্যেই খেলা শেষ হয়ে যেতে পারে। যদি বাংলাদেশ জিতে। কিন্তু যদি ইংল্যান্ড জিতে, তাহলে সেটি যে কোন দুটি ভাল বলেই হতে পারে। তাই হলো। পঞ্চমদিন শুরু হওয়ার পর আরও ১০টি রান স্কোরবোর্ডে যোগ করে বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর আর এগিয়ে যেতে পারেনি। স্টোকস বল হাতে নিয়ে তিন বলে ২ উইকেট তুলে নিলেন। তাতে করে বাংলাদেশ ২৬৩ রানেই অলআউট হয়ে গেল। সাব্বির একপ্রান্তে ১০২ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কায় ৬৪ রান করে অপরাজিত থাকলেন। ম্যাচটি জিতে গেলে ‘মহানায়ক’ হয়ে যেতেন সাব্বির। কিন্তু তা হতে পারলেন না। তবে ম্যাচটা যে এতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্র্ণ হলো। শেষদিন পর্যন্ত গড়াল এবং এতটা রোমাঞ্চ ছড়াল; সেটিতো সাব্বিরের জন্যই। আর তাই প্রশংসাতেও ভাসছেন সাব্বির। পঞ্চমদিন শুরুর আগেই সবার বোঝা হয়ে গিয়েছিল, ম্যাচটি ইংল্যান্ডের দিকেই হেলে রয়েছে। কারণ শুধু বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস ছাড়া প্রতিটি ইনিংসের শুরুতে এবং সকালের সেশনে ৩০ রানের ধারে কাছে ২ উইকেট পড়েছে যে মুড়ি-মুড়কির মতো! তাই যত ভয় ছিল। ৩৩ রান করার আগেই না আবার ২ উইকেটের পতন ঘটে যায়। তাই হলো। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে প্রথমদিনে প্রথম তিন উইকেট পড়তেতো একঘণ্টাও লাগেনি। দ্বিতীয়দিন আবার ৩১ রান করতেই ২ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসেও দেখা গেছে সেই একই চিত্র। দ্বিতীয়দিন ইংল্যান্ডকে অলআউট করে দিয়ে মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার আগেই ২৯ রানে ২ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। তৃতীয় দিনেতো ২৭ রানে ৫ উইকেটই হারিয়ে বসে। আর এখানেই দীর্ঘশ্বাস মিলে। আফসোসও হতে থাকে। এই ৫ উইকেটে যদি বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে লিড নিতে পারত, তাহলে খেলাতো পঞ্চমদিনে গড়াতোই না! বাংলাদেশ এরই মধ্যে জিতে যাওয়ারও কথা! কিন্তু হলো না। দুই দলের প্রথম ইনিংস শেষ হতেই ৪৫ রানে এগিয়ে যায় ইংল্যান্ড। যেটি ইংল্যান্ডকে শুরুতেই যেন ম্যাচের নিয়ন্ত্রণের আসনে বসিয়ে দেয়। এরপর ইংল্যান্ড যখন দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে, ২৮ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে। সেটি আবার তৃতীয়দিনে মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাওয়ার আগেই। তৃতীয়দিন শেষে যখন দ্বিতীয় ইনিংসে স্কোরবোর্ডে ৮ উইকেটে ২২৮ রান যোগ করে ফেলে ইংল্যান্ড, তখনই যেন বাংলাদেশকে হার চোখ রাঙ্গাতে থাকে। ততক্ষণে যে ২৭৩ রানে এগিয়ে যায় ইংলিশরা। চতুর্থদিন ১২ রান যোগ করতেই হারিয়ে বসে বাকি থাকা ২ উইকেট। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ইনিংসে ২৪০ রান করে ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের সামনে জিততে ২৮৬ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। এ রান অতিক্রম করতে গিয়ে অবশ্য ৩০ রানের নিচে বাংলাদেশ কোন উইকেট হারায়নি। তবে সকালের সেশন শেষ হওয়ার আগেই ২ উইকেট হারিয়ে বসে। দিন শেষে ৮ উইকেটে ২৫৩ রান করে বাংলাদেশ। ভয় যা সকালের সেশন নিয়েই। বাংলাদেশের ২ উইকেট না আবার টার্গেট পূরণের আগে সকালের সেশনেই কাত হয়ে যায়। তাহলে জয়টি ইংল্যান্ডের হাতেই ধরা দিয়ে দেবে। সাড়ে তিন ওভারেই সব খতম! মাত্র ১০ রান করতেই ২ উইকেটেরও পতন! অলআউট বাংলাদেশ। জয়ের আশারও মৃত্যু ঘটে যায়। প্রধান কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহে আগেই বলেছিলেন, ‘আমি অনেক প্রতিযোগিতাপূর্ণ টেস্ট ম্যাচ দেখেছি। তার মধ্যে এটিকেও অন্যতম সেরা ম্যাচ হিসেবে রাখব। এই উইকেটে খেলা অনেক কঠিন। কিন্তু আমার ছেলেরা দুর্দান্ত খেলেছে। বিশেষ করে সাব্বির অনেক চাপের মধ্যেও দুর্দান্ত খেলেছে।’ বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম বলেছেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই ২ উইকেটে ৩৩ রান অনেক কঠিন সমীকরণ। ৯০ শতাংশ ম্যাচ ওদের দিকেই হেলে ছিল। ওদের টেলএন্ডারদের প্রথম শ্রেণীতে সেঞ্চুরি আছে। আর আমাদের শেষের দিকের ব্যাটসম্যানদের এমন কিছু নেই প্রথম শ্রেণীতে। আর থাকলেও ওদের প্রথম শ্রেণী আর আমাদের প্রথম শ্রেণীর মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, এটি নিশ্চয়ই জানেন। হয়তো খারাপ লাগছে। তবে এই টেস্ট জিতলে আহামরি দল হয়ে যেতাম, তাও না। লক্ষ্য ছিল সেশন ধরে ধরে ভাল খেলার। আমরা ওদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছি।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘যদি নির্মম সত্যটা বলি (পঞ্চমদিনে) সকালে আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ২ উইকেটে ৩০-এর বেশি। তাদের হয়তো হাফ চান্স ছিল। তবে আমরাও ম্যাচ জেতার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করেছি। এ কারণে অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম।’ ইংল্যান্ড অধিনায়ক এ্যালিস্টার কুক বলেছেন, ‘দুর্দান্ত এক টেস্ট ছিল এটি। সত্যি প্রথম সেশনের পর ভাবতে পারিনি এই ম্যাচ পাঁচদিনে গড়াবে। অনেক চড়াই-উতরাই ছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তৃতীয় দিনের শুরুটা। তখন তারা (প্রথম ইনিংসে) ৭০-৮০ রানে পিছিয়ে ছিল, হাতে ৫ উইকেট। আমরা তবু লিড পেয়েছি। এটাই ছিল আসল পার্থক্য।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমার ১১ বছরের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা টেস্ট এটা। দুইটা টেস্ট সবসময়ই মনে থাকবে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করেছিলাম। ওটা এখনও আমার এক নম্বর। এরপর এটা হবে অন্যতম সেরা।’ তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে কিন্তু চট্টগ্রাম টেস্টটি ‘রিভিউ’য়ের জন্যই বিখ্যাত হয়ে থাকল। প্রথম ইনিংসই রিভিউয়ের নতুন রেকর্ড দিয়ে শুরু। এক ইনিংসে ১০টি রিভিউ দিয়ে শুরু চট্টগ্রাম টেস্ট। বিশ্বরেকর্ডও হলো। চট্টগ্রাম টেস্টে মোট ২৬ বার রিভিউ নেয়া হয়েছে। এক টেস্টে এত রিভিউয়ের ঘটনা আগে কখনই ঘটেনি। পঞ্চমদিনের শেষ দুটি উইকেটের নিষ্পত্তিও রিভিউয়েই হলো। দুটিই গেল ইংল্যান্ডের পক্ষে। এ টেস্টের মাধ্যমে আরেকজনের নামও ভালভাবেই সবার মুখে মুখে শোনা গেল। সেই নামটিÑ আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনার। একের পর এক আউট দিয়েছেন। রিভিউয়ে সেই আউটগুলো যে হলো না। তার জন্য টেস্টটি বিষাদময় হয়ে রইল। বাংলাদেশের জন্য বিষাদই হলো টেস্টটি। জেতার এত কাছে গিয়েও জয় তুলে নেয়া গেল না। বেদনা মিলল। তবে এই যে ইংল্যান্ডের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়া হলো, এতে গর্বও করতে পারেন সবাই। হারে বেদনা থাকলেও সঙ্গে যুক্ত এত ভাল খেলার গর্বও!
×