ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

অভ্যাস ৬ ॥ সিনারজাইজ

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

অভ্যাস ৬ ॥ সিনারজাইজ

(দ্বিতীয় পর্ব ) গত সপ্তাহে লিখেছিলাম ‘সিনারজাইজ’ অভ্যাসটির প্রথম পর্ব নিয়ে। আজকে লিখছি দ্বিতীয় পর্ব। ড. স্টিফেন কোভের লেখা ‘দি সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল’ বইটিতে যে সাতটি অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে, সেটার ষষ্ঠ অভ্যাসটি হলো ‘সিনারজাইজ’Ñ সৃজনশীল সহযোগিতার নীতিমালা। যদিও বাংলা ভাষায় ইংরেজী এই শব্দটির সঠিক পরিভাষা নেই, তবে বিষয়টি বুঝতে মানুষের খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকেই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েছেন যে, বিষয়টি তারা বুঝতে পারছেন। তবে যেই শব্দটি অভিধানে নেই, তা নিজের অভ্যাসের ভেতর আনা খুব কঠিন একটি কাজ হবে। কারণ, একা একা সিনারজি তৈরি করা যায় না। সিনারজি তৈরি করতে হলে আপনাকে আরও মানুষ লাগবে; এবং তাদেরও বিষয়টি বুঝতে পারতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে আমাদের সামগ্রিক যেমন উন্নতি হচ্ছে, একইভাবে মানুষের ধ্যান-ধারণা এবং কর্মপন্থারও পরিবর্তন হচ্ছে। দু’জন মানুষ যদি সত্যি সিনারজি বুঝতে এবং তার ঝুঁকিটা ধরতে পারে তাহলে সেই পথে তাদের হাঁটতে না যাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি আশা করছি, এই দেশের নতুন প্রজন্মের অনেকেই এগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারবেন এবং তাদের জীবনে আমরা বিভিন্ন ধরনের সিনারজি দেখতে পাব। তবে, এটাকে অভ্যাসে আনতে পারার বেশকিছু নিয়ম আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলার আগে এর অন্যান্য প্যারামিটার দেখে নেয়া যাক। ॥ দুই ॥ সিনারজি খুবই রোমাঞ্চকর একটি বিষয়। একইভাবে সৃষ্টিশীলতাও একটি রোমাঞ্চকর বিষয়। এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা যার হয়নি, সে আসলে বুঝতেই পারবে না কী এক অদম্য উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে মানুষ। কী এক অপার সৃষ্টিসুখের উল্লাস তাড়না করে তাদের- যেমনটা বুঝতে পারে না প্রেমে না পড়া বোধহীন কোন এক দু’পায়ী প্রাণী। কিন্তু এর জন্য চাই খোলা মন এবং যোগাযোগ। এই খোলা মন নিয়ে যখন কোন একটি গোষ্ঠী নিজেদের ভেতর ভাবের আদান-প্রদান করে, তার মাধ্যমে যে ফল তৈরি হয়, সেটা আসলে অভূতপূর্ব এবং এটা ঘটার সম্ভাবনা এতটাই বাস্তবভিত্তিক যে, এই পথে হাঁটার ঝুঁকি নেয়াটা অর্থবহ। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি খোলাসা করা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রে ডেভিড লিলিয়েনথালকে নবগঠিত আণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান করা হয়। তখনও জাপানের পারমাণবিক বোমার গন্ধ আকাশে-বাতাসে। মানুষ এর ভয়াবহতায় শঙ্কিত এবং স্তম্ভিত। লিলিয়েনথালের ওপর গুরুদায়িত্ব পড়ল এই বিভাগের। লিলিয়েনথাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত কিছু সফল ব্যক্তিকে একত্রে করলেন, যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন এবং তারা প্রত্যেকেই একদম ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে এসেছেন। তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। তার ওপর পারমাণবিক কমিশনের দীর্ঘ এজেন্ডা তো রয়েছেই। সবাই ওগুলোতে ঝাঁপ দিয়ে কাজে নামতে চাইলেন। এদিকে সংবাদ মাধ্যমও প্রচুর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। কিন্তু লিলিয়েনথাল সেই চাপে ভীত হলেন না। তিনি কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে দিলেন প্রত্যেকের সঙ্গে ইমোশনাল ব্যাংক এ্যাকাউন্ট তৈরি করতে। তিনি এই বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের একে অপরকে জানা, বোঝা, তাদের উদ্দেশ্য, তাদের কনসার্ন, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডÑ সবকিছু জানার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাদের মধ্যে ভাব আদান-প্রদানের জন্য খুব সুন্দর একটি পরিবেশ তৈরি করে দিলেন, যেন এই সদস্যদের মাঝে ভাল একটি বন্ধন তৈরি হয় এবং এই কাজটি করতে গিয়ে বাড়তি সময় নেয়াতে তিনি প্রচ- সমালোচনার মুখে পড়েন। তবে প্রকৃত ফল হলো খুবই ভাল। ওই দলটি নিজেদের ভেতর খুবই বিশ্বাসী একটি সম্পর্ক তৈরি করে ফেলল। তারা একে অপরের কাছে নিজেকে মেলে দিতে শুরু করল এবং ধীরে ধীরে তারা সম্মিলিতভাবে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠল। তারা একে অপরকে এতটাই সম্মান দেখাতে শুরু করল যে, কেউ কিছু একটা প্রস্তাব করলে অন্যরা মুহূর্তেই সেটাকে সমালোচনা করছে না, কিংবা ডিফেন্ড করার চেষ্টা করছে না। তারা মনে করছে, এই যোগ্যতার একজন মানুষ যদি কোন বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে আসলেই দ্বিমত করার মতো কোন বিষয় আছে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা দাঁড়াল এমন যে, আমি তো তাহলে বিষয়টা বুঝতে পারছি না, আপনি একটু বুঝিয়ে বলেন। তাদের ভেতর রক্ষণশীলতা কেটে গিয়ে এক ধরনের সহযোগিতার হাত তৈরি হলো এবং তাদের ভেতর বিরল একটি কালচারের জন্ম নিল। এর মাধ্যমে ওই কমিশন অনেক কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল। যদি তাদের ভেতর সেই সিনারজি তৈরি না হতো, তাহলে অনেক কিছুই ভিন্নমতের কারণে পাস করানো যেত না। আমাদের দেশের মানুষ, রাজনীতিবিদদের, বিভিন্ন পর্যায়ের উঁচু কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে অনেক ভাল ফল পাওয়া যেত। ॥ তিন ॥ সিনারজি তৈরির সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাসের একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। পারস্পরিক বিশ্বাস যদি খুব কম থাকে, সেখানে খুব নিচু স্তরের যোগাযোগ ঘটে। ওই পরিবেশে মানুষ খুব বেশি রক্ষণশীল হয়ে ওঠে, সব সময় নিজেকে প্রটেক্ট করার চেষ্টা করে এবং বেশিরভাগ সময়ই আইনের ভাষায় কথা বলে। যখনই দেখবেন কেউ আপনার সঙ্গে আইনের বিষয় তুলে আনছে; বলছে যে, এটা তো আমার আইনী অধিকার, আমার অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে, এটা না পেলে আমি আইনের আশ্রয় নেব ইত্যাদি। তখনই বুঝবেন ওখানে বিশ্বাসের বিশাল ঘাটতি রয়েছে। ওখানে সম্পর্ক খুব নাজুক এবং কাজ করার ন্যূনতম পরিবেশ থাকার কোন কারণ নেই। এই ধরনের পরিবেশ সব সময় উইন-লুস নয়ত লুস-উইন পরিস্থিতি বিরাজ করে। কে কাকে ঠকাবে সেই প্রতিযোগিতায় নামে মানুষ। এই ধরনের পরিস্থিতি মোটেও ইফেক্টিভ নয়। এর থেকে একটু ভাল পরিবেশ হলো সম্মানজনক যোগাযোগ। এটা হলো এমন একটি পরিবেশ যেখানে মূলত খুব পরিপক্ব মানুষ বিচরণ করে থাকে। তারা একে অপরকে সম্মান করে; কিন্তু এমন কিছু করবে না যা অন্য মানুষের সঙ্গে কনফ্লিক্ট তৈরি করে। তারা খুব সুন্দর ব্যবহার করবে, মুখে একটা হাসি ধরে রাখবে, তারা হয়ত বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে একে অপরকে বুঝতেও পারবে, কিন্তু তারা সেগুলোর গভীরে গিয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে যাবে না। এরা নিরাপদ খেলা খেলতে চাইবে। আপনি অনেক কর্মক্ষেত্রে এমন লোকজন পাবেন, যারা কোন আগে-পিছে থাকবে না; কোন স্ট্যান্ড নেবে না- সেটা সত্যি হোক, আর মিথ্যাই হোক। এরা ভদ্র এবং অন্যের সঙ্গে কোন বিত-ায় না জড়িয়ে কাজ করতে চায়। এই ধরনের সম্মানজনক পরিস্থিতি কাজের জন্য ঠিক আছে; তবে এরা যেহেতু নিজেদের মেলে দেয় না, তাই এখানে সৃষ্টিশীল কিছু ঘটে না। এখানে মূলত স্টেরিওটাইপ কিছু কাজ হয়ে থাকে। যে যার মতো দায়িত্ব পালন করে যায়, মাসের শেষে বেতনটা হাতে পেলেই হলো। এরা মূলত কম্প্রোমাইজ করে কাজ করে থাকে। ফলে এখানে ১+১=১.৫ হয়ে যায়। এদের যোগফল এমনকি দুইও হয় না, দেড় হয়। কারণ এখানে দু’পক্ষই দেয়া-নেয়ার মধ্যে নিজেকে আটকে ফেলে। এদের ভেতরের যোগাযোগটা একদিকে যেমন রক্ষণশীল নয়, আবার উন্মুক্তও নয়। এরা রাগও করে না, কাউকে মেনিপুলেটও করে না। তবে তারা সৎ এবং সম্মানজনক। কিন্তু এদের পক্ষে কখনই সিনারজি তৈরি করা সম্ভব নয়। এরা বড়জোর উইন/উইন-এর খুব নিচু স্তরে কাজ করতে পারে। আমি আগেই বলেছি, সিনারজি হলে সেখানে ১+১ এর ফল হবে ৮, নয়ত ১৬, কিংবা ১ হাজার ৬০০। সিনারজি তৈরি করতে হলে প্রয়োজন খুবই উঁচুমানের বিশ্বাস এবং সহযোগিতা (চিত্র : গ্রাফটি লক্ষণীয়)। আপনি যদি কাউকে খুব বিশ্বাস করেন এবং তার হাত ধরে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করেন সেখানে সিনারজি তৈরি হতে পারে এবং তার ফলাফল হবে, আপনি যা পরিকল্পনা করেছিলেন তার থেকে অনেক গুণ বেশি এবং সকল পক্ষকেই সেটা জানতে হবে যে, এমন একটি সিনারজি যদি তৈরি করা যায় তাহলে ফল অলৌকিক হতে পারে এবং এই রসায়নটি যখন ঘটে তখন সকল পক্ষই সেই রসে আপ্লুত হয়, সেটা উপভোগ করে। ॥ চার ॥ একটা ছোট পরিস্থিতির চিন্তা দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করি। আগামী পর্বে এই অভ্যাসটির ইতি টানার চেষ্টা করব। একটি ছুটির মৌসুম। বাচ্চাদের স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা তাদের একটি চমৎকার সময় উপহার দেয়ার জন্য দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। সেখানে হ্রদে নৌকা বাওয়া যাবে, বড়শি দিয়ে মাছ ধরা যাবে, সঙ্গে থাকছে রাতের বার-বি-কিউ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে চমৎকার ছুটির পরিকল্পনা। পুরো বছর ধরে তিনি এমনটাই ভেবে রেখেছেন; এবং সেই বনের ভেতর কটেজে বুকিংও দিয়ে রেখেছেন। তার ছেলেমেয়েরা বিষয়টি নিয়ে খুবই উত্তেজনায় আছে; কবে আসবে সেই মুহূর্তটি। অন্যদিকে তার স্ত্রী এই ছুটির সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যেন ২৫০ মাইল দূরে থাকা তার মার সঙ্গে কাটাতে পারে। তার পক্ষে বৃদ্ধা মাকে দেখতে যাওয়া খুব একটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটা তার জন্য একটু মোক্ষম সময়। দু’জনই তাদের মতো পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। তাদের এই বিপরীতমুখী অবস্থান উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। তাদের সম্পর্কে শীতলতা আসতে পারে। কী করা যায় এখন? এমন পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক সময়ই পড়তে হয়। এমন অবস্থায় আপনি হলে কী করতেন? উত্তরটা আমি এখনই দিচ্ছি না। আপনি একটি সপ্তাহ ভাবুন। সম্ভব হলে আমাকেও ই-মেইল করে জানাতে পারেন। আগামী সপ্তাহে মিলিয়ে নেয়া যাবে! ২২ অক্টোবর ২০১৬ [email protected]
×