ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

তবে ছোট অঙ্কের ঋণ আদায় সন্তোষজনক

ঋণ পুনঃতফসিলে ছোট ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২২ অক্টোবর ২০১৬

ঋণ পুনঃতফসিলে ছোট ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত

রহিম শেখ ॥ রাজনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপের ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সুবিধায় দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল করা হলেও বঞ্চিত হন ছোট ব্যবসায়ীরা। পরবর্তী সময়ে ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণ রয়েছে এমন গ্রুপের ঋণ পুনর্গঠন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেন দুই শতাধিক ব্যবসায়ী। সুবিধা চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে শেষপর্যন্ত আদালতের শরণাপন্ন হন এসব ব্যবসায়ীরা। গত দেড় বছরে এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে ৩০০ রিট দায়ের করেন উদ্যোক্তারা, যার মধ্যে মাত্র ৬টি রিট নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি সবই ঝুলে আছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুনঃতফসিল করা ঋণের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় ঋণের আদায়ে বেশি খারাপ অবস্থা। কিন্তু ছোট অংকের ঋণের আদায় সন্তোষজনক। তারপরও এ ধরনের সুবিধা পাননি ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণ রয়েছে এমন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ব্যাংক খাতে আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণের জন্য ২০১২ সালের জুন মাসে ঋণ শ্রেণীকরণ ও পুনঃতফসিল এবং প্রভিশনের নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। এতে ঋণ শ্রেণীকরণে যেমন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তেমনি পুনঃতফসিলের সুযোগ কমিয়ে আনা হয়। এ নীতিমালার আওতায় ব্যাংকগুলো নিজেরাই তাদের গ্রাহকের শ্রেণীকৃত ঋণ তিনবার পুনঃতফসিল করতে পারে। এর বেশির ভাগ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ পুনঃতফসিলে বিশেষ সুবিধা দিতে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট গ্রহণের শর্ত শিথিল ও ঋণের যৌক্তিক মেয়াদ ঠিক করা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনাপত্তি নেয়ার শর্ত দেয়া হয়। এরপর ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিলের প্রতিযোগিতায় নামে। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এ সময় প্রায় সাত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে খেলাপীর তকমা থেকে রেহাই দেয়া হয়। পরে ৫০০ কোটিরও বেশি ঋণ রয়েছে এমন বড় শিল্প গ্রুপগুলোর পক্ষ থেকেও খেলাপী ঋণ পুনর্গঠনে বিশেষ ছাড় দিতে চাপ সৃষ্টি করা হয়। গত বছরের জানুয়ারি মাসে এ সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা দিয়ে আরেকটি নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই নীতিমালার নামমাত্র ডাউন পেমেন্টে খেলাপী ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়ন্ত্রক হিসেবে সবপক্ষের সুবিধা বিবেচনা করে তারা যে কোন নীতিমালা প্রণয়ন করেন। তবে যে কোন কিছুর ক্ষেত্রে একটি সীমা নির্ধারণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি করা হয়েছে। এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিবেচনায় বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবদান, দেশীয় বাজার যাচাই ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ থাকা গ্রাহকদের এ ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ওপর পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৬টি শিল্প গ্রুপের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৫ হাজার ৭১০ কোটি টাকা পুনর্গঠনের আবেদন আসে। তবে এর মধ্যে ৬টি গ্রুপের এককভাবে ব্যাংক খাতে সম্মিলিত ঋণ ৫০০ কোটি টাকার কম হওয়ায় প্রাথমিক বাছাইয়ে তা বাতিল করা হয়। আর ১০টি গ্রুপের ১৪ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার প্রস্তাব যাচাই করে অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ১ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা, যমুনা গ্রুপের জনতা ব্যাংক থেকে পাঠানো ৫৯৮ কোটি ৮ লাখ টাকা এবং রতনপুর গ্রুপের পক্ষে জনতা ব্যাংক থেকে পাঠানো ৬৮৮ কোটি ৪৫ লাখ ও সোনালীর ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। অন্য প্রস্তাবগুলো অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে আবারও খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিলে ব্যবসায়ীদের ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত আরও দুই শতাধিক আবেদন বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা পড়েছে। সূত্র জানায়, ইব্রাহীম গ্রুপ কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে। আবুল হোসেন গ্রুপের পক্ষে আবেদন আসে ৪৯৭ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের জন্য। দুটি আবেদনের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী সব ডকুমেন্ট দেয়া হয়। তবে ঋণ ৫০০ কোটি টাকার কম হওয়ায় তা বিবেচনা করা হয়নি। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করলেও তারা এ সুবিধা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে গেছেন। এসব উদ্যোক্তা বলছেন, যেসব ক্ষতির জন্য ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেয়া হয়েছে, তারাও ওই ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছেন। বড় উদ্যোক্তারা সুবিধা পেলে তাদেরও তা প্রাপ্য। আর ক্ষতি পোষানোর সক্ষমতা ছোটদের তুলনায় বড়দের বেশি থাকে। ফলে বড় গ্রুপের চেয়ে তাদের ঋণ পুনর্গঠনের প্রয়োজন বেশি। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৫০০ কোটি টাকার কম থাকা উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ৩০০ রিট দায়ের হয়েছে। এ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬টি রিট। ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধার জন্য উচ্চ আদালতে প্রথম রিটটি গত বছরের ২২ মার্চ দায়ের হয় গাজীপুর পেপার বোর্ডের পক্ষে। এরপর বিভিন্ন সময়ে খানসন জুটেক্স লিমিটেড, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, সামান্নাজ সুপার অয়েল, এসএ অয়েল লিমিটেড, এমএস সুইটার হোল্ডেন, শাহ আমানত সিটিজেন টেক্সটাইল, সাউথ ইস্টার্ন অয়েল রিফাইনারিসহ কয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব রিট দায়ের করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়েছে, যাতে খেলাপী ঋণ কমে আসে। খলাপী ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোর তদারকি অব্যাহত আছে। ব্যাংকগুলোও খেলাপী ঋণ কমানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছে। তবে ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণ রয়েছে এমন ব্যবসায়ীদেরও বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। ঋণ পুনঃতফসিলের বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিআইবিএম। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পুনঃতফসিল হওয়া ঋণের ওপর। সেখানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১২ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। আর গত পাঁচ বছরে গড়ে ১০ হাজার ৯১০ কোটি টাকা করে পুনঃতফসিল হয়েছে। পুনঃতফসিল করা ঋণের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় ঋণের আদায়ে বেশি খারাপ অবস্থা। তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রথমবার পুনঃতফসিল হওয়া ঋণের আদায় ছিল মাত্র ২৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর পাঁচ বছরে গড়ে ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ আদায় হলেও বড় ঋণের আদায় ছিল ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। দ্বিতীয় দফা পুনঃতফসিল হওয়া মোট ঋণের মাত্র ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ আদায় হয় ২০১৪ সালে। আর পাঁচ বছরে গড় আদায় ছিল ২৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। তবে বড় ঋণের গড় আদায় ছিল ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর তৃতীয় দফা বা এর বেশিবার পুনঃতফসিল হওয়া ঋণের ৩২ দশমিক ২৫ শতাংশ আদায় হয় ২০১৪ সালে। পাঁচ বছরে গড় আদায়ের হার ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ হলেও বড় ঋণ আদায় হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এতে বোঝা যাচ্ছে, পুনঃতফসিল করা বড় ঋণের আদায় হচ্ছে খুব কম। এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের যে সুবিধা দেয়া হয়েছিল, ওই সুবিধা দেয়ার পর সেসব ঋণের বর্তমান অবস্থা জানতে ব্যাংকগুলোর কাছে তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ওই ঋণগুলো ঠিকভাবে আদায় হচ্ছে কিনা, গ্রহীতা ঠিকমতো ঋণটি ফেরত দিচ্ছে কিনা, ঋণটি আবার খেলাপী হলো কিনা, খেলাপী হওয়ায় সেটি পুনঃতফসিল করা হয়েছে কিনাÑ এসব বিষয় পর্যালোচনা করা হবে।
×