ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৬’ প্রযুুক্তিমেলা উদ্বোধন

সাইবার সিকিউরিটি সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২০ অক্টোবর ২০১৬

সাইবার সিকিউরিটি সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাইবার সিকিউরিটির সক্ষমতা বৃদ্ধির তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করে কেউ যেন অপরাধ কার্যক্রম চালাতে না পারে সে ব্যবস্থাও আমাদের নিতে হবে। বিশেষ করে আর্থিক খাত এবং গোপনীয় বিষয়ের নিরাপত্তা যাতে কোনভাবেই বিঘিœত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আর এ লক্ষ্যে জনসম্পদ তৈরি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হবে। বুধবার সকালে রাজধানীর বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটিতে দেশের সর্ববৃহৎ তথ্য প্রযুক্তি মেলা ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-২০১৬’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট-২০১৬ প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। এ আইনের আওতায় বাংলাদেশে বিশ্বমানের ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন, সাইবার সিকিউরিটি এজেন্সি গঠন, সাইবার ইন্সিডেন্স রেসপন্স টিম (সিইআরটি) প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চ পর্যায়ের ডিজিটাল সিকিউরিটি কাউন্সিল গঠন করা হবে। ‘নন স্টপ বাংলাদেশ’ থিমকে সামনে রেখে সরকারের আইসিটি বিভাগ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সহযোগিতায় তিনদিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করা হয়। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের সভপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও এ্যাক্সেস টু ইনফর্মেশন (এটুআই) কর্মসূচীর পরিচালক কবির বিন আনোয়ার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার, বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতি তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে নারীদের কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে ৬টি স্মার্ট বাসেরও উদ্বোধন করেন। আলোচনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিএনপি-জামায়াত সরকার বিনা খরচে সাবমেরিন কেবলে সংযুক্ত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও নিরাপত্তার অজুহাতে তা হাতছাড়া করে। আমরা সরকার গঠন করে দেশের স্বার্থে টাকা খরচ করে সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হই। তিনি বলেন, দেশে কোন বিকল্প সাবমেরিন কেবল না থাকায় আমরা দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছি। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলে বাংলাদেশ প্রায় ১ হাজার ৩০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ অর্জন করবে। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উড্ডয়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। ২০১৭ সালে এর যাত্রা শুরুর পর নিজস্ব চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা স্যাটেলাইট ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে পারব। তাই আসুন দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে সরকারের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তাঁর সরকার শিক্ষাখাতকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ৬ষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ১৭টি টেক্সট বইকে ডিজিটাল টেক্সটবুক বা ই-বুকে রূপান্তর করেছি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে আমরা সারাদেশে ৩০ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম স্থাপন করেছি। সারাদেশে ২ হাজার ১টি ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন করেছি। আরও ৯০০টি ল্যাব প্রতিষ্ঠার কাজ শেষের পথে। ৬৪ জেলায় ৬৫টি ল্যাংগুয়েজ ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে সাড়ে ৫ হাজারেরও অধিক ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করেছি। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের মধ্যে আরও ১০ হাজার ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ স্থাপন করা হবে। আইসিটি খাতে গবেষণার জন্য ফেলোশিপ ও বৃত্তি প্রদান এবং উদ্ভাবনীমূলক কাজের জন্য অনুদান সম্পর্কিত নীতিমালা-২০১৩ প্রণয়নের মাধ্যমে আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, উদ্ভাবনী কর্মকা-কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং আইটি স্টার্ট-আপ উদ্যোগকে সম্প্রসারণ করতে তাঁর সরকার ‘ইনোভেশন ডিজাইন এন্টারপ্রেনারশিপ একাডেমি (আইডিইএ) প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা ‘ওয়ান থাউজেন্ড ইনোভেশন-২০২১’ নামের এক বিস্তৃৃত কর্মযজ্ঞও শুরু করেছে। এছাড়া গেমিং শিল্পে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে ‘স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর মোবাইল গেম এ্যান্ড এ্যাপলিকেশন’ প্রকল্পও গ্রহণ করেছে। জয়ের কাছ থেকেই কম্পিউটার শিক্ষা নিয়েছি ॥ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নে আমাদের প্রচেষ্টা বিশ্ববাসীর সুনাম অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য ‘আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট এ্যাওয়ার্ড ২০১৬’ পেয়েছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তাঁকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অন্যতম কারিগর আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘ওর (জয়) কাছ থেকেই আমি কম্পিউটার চালানো শিখেছি। মা হিসেবে এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ পুরস্কারে আমি সম্মানিত বোধ করেছি। এ অর্জন শুধু সরকারের নয়, এ কৃতিত্ব দেশের জনগণের।’ দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ০৫ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। ৫ কোটি মানুষ নিম্ন আয়ের স্তর থেকে মধ্যম আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার আমরা ২২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে পুনরায় জনগণের সেবার সুযোগ পায়। আমরা সরকার গঠন করে মানুষকে উন্নত জীবনদানের প্রতিজ্ঞা করি। তারই অংশ হিসেবে আমরা টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ঢেলে সাজাই। বিএনপি সরকারের সময় মোবাইল ফোনের একক মনোপলী ব্যবসা ভেঙ্গে দিয়ে ব্যক্তিখাতকে উš§ুক্ত করে দেয়াতেই আজ সবার হাতে মোবাইল ফোন আসতে পেরেছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে আমাদের সরকার বিগত সাড়ে সাত বছরে আইসিটি খাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। আজ দেশের প্রতিটি উপজেলা ফাইবার অপটিক কেবলের আওতায় এসেছে। যে ব্যান্ডউইথের দাম ২০০৭ সালে ছিল ৭৬ হাজার টাকা, তা কমিয়ে বর্তমানে মাত্র ৬২৫ টাকায় এনেছি। ইতোমধ্যে প্রায় সব উপজেলা থ্রি-জি সেবার আওতায় এসেছে। আগামী ২০১৭ সালের মধ্যেই ফোর-জি চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে আজ প্রায় ১৩ কোটির বেশি মোবাইল সিম ব্যবহƒত হচ্ছে। ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৫ হাজার ২৫০টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করছে। ৩ হাজার ডাকঘরেও ডিজিটাল সেবা দেয়া হচ্ছে। কয়েকটি উন্নত দেশসহ প্রায় ৪০টি দেশে আমরা সফটওয়্যার ও আইসিটি সেবা রফতানি করছি। তিনি বলেন, সরকারী সেবা পেতে এখন আর মানুষকে অযথা হয়রানির শিকার হতে হয় না। লাইনে দাঁড়িয়ে ফরম জমা দেয়া লাগে না। এক সময় এদেশে ‘হাওয়া ভবন’ সৃষ্টি করে ঘুষ বাণিজ্যকে যে প্রাতিষ্ঠানিকরূপ দেয়া হয়েছিল। আমরা তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তা বন্ধ করেছি। টেন্ডার বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। সরকারী টেন্ডারগুলো এখন ই-জিপিতে চলে গেছে। যুব সমাজের কর্মসংস্থানে সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, আইসিটি ব্যবহার করে তরুণ জনগোষ্ঠীর আউটসোর্সিংয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমরা ‘লার্নিং এ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এ প্রকল্পের আওতায় ৫৫ হাজার তরুণ-তরুণীকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে ২০ হাজার জনকে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের বর্তমানের জনশক্তি দ্বিগুণ করে ২০২১ সালের মধ্যে ২০ লাখ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বর্তমানে দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের তথ্য-প্রযুক্তি পণ্য রফতানি বাড়িয়ে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি পণ্যের রফতানি বাড়াতে ও দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন মোস্তফা জব্বার। তিনি বলেন, সমমূলধন ও উদ্যোক্তা তহবিল (ইইএফ) থেকে আগে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে ঋণ দেয়া হলেও গত একবছর ধরে তা বন্ধ আছে। ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা। ইইএফ চালু করাসহ তথ্য-প্রযুক্তি খাতের কোম্পানির জন্য সহজ ঋণ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ তহবিল গঠনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন তিনি। এছাড়া দেশীয় উৎপাদকদের উৎসাহ দিতে বিদেশ থেকে কম্পিউটার আমদানির ওপর শুল্ক আরোপেরও প্রস্তাব করেন এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। প্রসঙ্গত, এবারের মেলায় ৪০টি মন্ত্রণালয় ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে কি কি সেবা দিচ্ছে তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হবে। মেলায় শীর্ষস্থানীয় শতাধিক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাদের ডিজিটাল কার্যক্রম তুলে ধরবে। তিন দিনব্যাপী আয়োজনে মাইক্রোসফট, ফেসবুক, একসেন্সার, বিশ্বব্যাংক, জেডটিই, হুয়াওয়েসহ খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানের ৪৩ জন বিদেশী বক্তাসহ দুই শতাধিক বক্তা ১৮টি সেশনে অংশ নেবেন। এছাড়া নেপাল, ভুটান, সৌদি আরবসহ ৭টি দেশের ৭ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে অংশ নেবেন।
×