ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন চুক্তি এবং একটি বিবৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন চুক্তি এবং একটি বিবৃতি

গত ৭ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সংক্রান্ত চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে দেশের ১০ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় জ্বালানি বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নেবে নাÑ এমন সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ওই ১০ জন বিশিষ্টজন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই ১০ জনের কেউই নিউক্লিয়ার বিশেষজ্ঞ নন। তাহলে প্রশ্ন আসে তারা কি এর ওপর কোন ধরনের বিশেষত, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের মতো এত বড় ও উচ্চতর প্রযুক্তির একটি প্রকল্প চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাবে না গিয়ে যে সংবাদের ভিত্তিতে মানে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় জ্বালানি রাশিয়া ফেরত নেবে না- এই তথ্য আদৌ সত্য কিনা তা খতিয়ে দেখা যাক। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের স্পেন্ট ফুয়েল রাশান ফেডারেশন ফেরত নেয়ার বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ইন্টার গবার্নমেন্টাল এগ্রিমেন্ট বা আইজিএ-এর আর্টিক্যাল ৮-এর ক্লজ ২-এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে। স্বাক্ষরিত আইজিএ উভয় দেশের সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ও অনুমোদিত দলিল। এ ধরনের এগ্রিমেন্ট বাতিলের বিধানও আছে। কিন্তু এই এগ্রিমেন্ট বাতিল হলেও আইজিএ-এর আর্টিক্যাল ৮ বলবত থাকবে, যা আইজিএ-এর আর্টিক্যাল ১৯-এর ক্লজ ৫-এ উল্লেখ আছে। মানে উভয় সরকার কোন কারণে আইজিএ বাতিল করলেও রাশান ফেডারেশন কর্তৃক স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল রাশিয়া ফেরত নেয়া সংক্রান্ত বিধানটি আজীবন বলবত থাকবে। সুতরাং এ নিয়ে উদ্বেগের কোন ভিত্তি নেই। বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে রাশিয়ায় স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ফেরত নেয়ার আরও কিছু বিষয়ের অবতারণা করা প্রয়োজন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র অপারেশনে যাওয়ার দশ বছর পর স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল ফেরত নেয়ার কাজ শুরু হবে। এই দশ বছর রূপপুরে স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল সংরক্ষণে রাশান ফেডারেশন কিভাবে, কতখানি সহযোগিতা বাংলাদেশকে করবে, রূপপুর থেকে রাশিয়ার স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের কে কত ভাগ বহন করবে প্রভৃতি বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, এমনকি দরকষাকষি হতে পারে। তাই এক্ষেত্রে স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল রাশান ফেডারেশন ফেরত নেবে না কিংবা রাশিয়া তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে তা বলা যাবে না। যে কোন কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে, এখান থেকে কোন তেজস্ক্রিয় পরিবেশে ছড়িয়ে কোন বিপর্যয় ঘটলে কিংবা রূপপুরের জন্য সরবরাহকৃত পারমাণবিক জ্বালানি বাংলাদেশে আনার পর তা থেকে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় বাংলাদেশকেই নিতে হবে- রাশান ফেডারেশন নেবে না। বস্তুত কোন দুর্ঘটনার দায়িত্ব এক পক্ষকেই নিতে হবে, যা স্বত্বাধিকারী পক্ষই নিয়ে থাকে। যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের অপারেশনকালে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসার দায়িত্ব এক পক্ষ নিলেই যথার্থ হবে। এর ব্যত্যয়ে দুই পক্ষের টানাটানিতে চিকিৎসাই হবে না। এবার দেখা যাক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা কতখানি? রূপপুরে স্থাপিত পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রটিতে পারমাণবিক নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা ভেঙ্গে দুর্ঘটনাইবা ঘটবে কেন? পারমাণবিক দুর্ঘটনা কি বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার মতো পৃথিবীর দেশে দেশে বিদ্যুত উৎপাদনরত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে হরহামেশাই সংঘটিত হচ্ছে? রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র কি ধোলাইখালের মিস্ত্রিরা পরিচালনা করবেন? ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি থ্রি-প্লাস প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের রি-এ্যাক্টর রূপপুরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়ে স্থাপিত হবে। এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত তথ্যের কতখানি জানা যাবে এবং সেখান থেকে বৃহৎ পরিসরে জানান দেয়া যাবে তারও সীমারেখা থাকা উচিত। অতি অনুসন্ধিৎসু হয়ে এই সীমারেখা পেরিয়ে তথ্য প্রচার করলে ভুল বোঝাবুঝি তথা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। আর এর ফলে সুনিপুণভাবে পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নই কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্য পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিটি পর্যায় যেভাবে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কঠোরভাবে দেখভাল করা হয়, ঠিক একইভাবে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সংক্রান্ত তথ্য ঢালাওভাবে প্রচারেও বিধিনিষেধ থাকা জরুরী। আর এমন বিধিনিষেধ না থাকলে অনেক বিরোধিতা সত্ত্বেও পৃথিবীর দেশে দেশে এত পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ। অবাধ তথ্যের অজুহাতে নির্মাণাধীন কোন পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের সব তথ্যের প্রচারণা সমীচীন নয়। বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনে একেবারে নবীন বিধায় পারমাণবিক তথ্য প্রচারে দায়িত্বশীলতা, সীমারেখা তথা বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এই সুযোগে কোন কোন মহল সচেতনভাবে সুদূরপ্রসারী এজেন্ডা বাস্তবায়নের অপপ্রয়াসে লিপ্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হতে পারে। দেশী-বিদেশী অনেক মহল বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের মতো বিদ্যুত খাতে এগিয়ে যাক তা ঠেকাতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। ‘তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ফেরত নেবে না রাশিয়া’ এই শিরোনামের সংবাদ প্রচারও ছিল ওই অপপ্রয়াস বাস্তবায়নের একটি টেস্ট কেস। বাংলাদেশের উন্নয়ন বিরোধীরা সম্যক জানে, পারমাণবিক বর্জ্য রাশিয়া ফেরত নেবে নাÑ এই সংবাদে বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠীকেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে। এমনিতেই পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন তথা পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি বাতিল করতে হবে দেশের ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে এ ধরনের বিবৃতি বের করে আনা কিংবা মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেরকম স্পেস তৈরিতে যারা নেপথ্যের কারিগর হিসেবে কাজ করেছে তাদের সম্পর্কে উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্বার্থে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক
×