ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিনপিংয়ের সফর কালে চুক্তি সই

কয়লা বিদ্যুত উৎপাদনে প্রথম পাশে এলো চীন

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

কয়লা বিদ্যুত উৎপাদনে প্রথম পাশে এলো চীন

রশিদ মামুন ॥ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনে প্রথম চীনকেই পাশে পেল বাংলাদেশ। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরে একটি বৃহৎ বিদ্যুত কেন্দ্রের ঋণ চুক্তির সঙ্গে দুটি কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। জ্বালানি বহুমুখীকরণে চীনের এই সহায়তা বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উৎপাদন ছাড়াও সঞ্চালন এবং বিতরণ মিলিয়ে বিদ্যুতখাতে চীনের সঙ্গে ৪ দশমিক ৭৭৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে শুক্রবার। এছাড়া উভয় দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণের ক্ষেত্র উন্মোচিত করতে সমঝোতায় পৌঁছেছে। শুক্রবার বিকেলে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্দা সরিয়ে দুটি বিদ্যুত কেন্দ্র্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এর মধ্যে একটি বিদ্যুত কেন্দ্রর নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় শুরু হয়েছে। চীন ও বাংলাদেশের সমান অংশীদারিত্বের কোম্পানি বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। কেন্দ্রটি নির্মাণে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে। অন্য বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য দেশের বেসরকারী শিল্প উদ্যোক্তা এস আলম গ্রুপ চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা হবে এক হাজার ২২৪ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্যও চীন থেকেই ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে বলে মনে করছে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম, খোরশেদুল আলম চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের পর জনকণ্ঠকে জানান চীন থেকে আমরা পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য এক দশমিক ৯৮৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত চুক্তি হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির কাজ আগে থেকেই শুরু করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ (শুক্রবার) কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো। এছাড়াও জ্বালানিখাতের উন্নয়নে বহুল প্রত্যাশিত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল, বিদ্যুত সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানিকে ঋণ দেয়ার পাশাপাশি ঢাকার সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকেও (ডিপিডিসি) ঋণ সহায়তার চুক্তি স্বাক্ষর হয় শুক্রবার বিকেলে। মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই দেশের বিদ্যুতখাতের উন্নয়ন জ্বালানির বহুমুখীকরণ নীতি গ্রহণ করা হয়। এই নীতিতে প্রাধান্য দেয়া হয় কয়লাকে। দেশী কয়লা উত্তোলনে পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এরফলে সরকার আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার বিনিয়োগ আহ্বান করলে ভারত, জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, কোরিয়া সরকারের সঙ্গে কয়লাচালিত বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য চুক্তি করে। তবে এরমধ্যে চীন সব থেকে এগিয়ে রয়েছে। সরকারের সঙ্গে ৫০ ভাগ মালিকানায় একটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পটুয়াখালীতে শুরু হয়েছে। চীনের সিএমসি এবং রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (্এনডব্লিউপিজিসিএল) বিদ্যুত কেন্দ্রটির উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। এখানে আরও এক হাজার ৩২০ মেগাওয়টের আরও একটি কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। ওই কেন্দ্রটিও চীন এবং বাংলাদেশের সমান অংশীদারিত্বে হবে। এর বাইরে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হওয়া অন্য কেন্দ্রটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ বলছে, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। এস এস পাওয়ার লিমিটেড ১ ও ২ নামে দুই কোম্পানি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬১২ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট স্থাপন করবে। দুই দশমিক চার বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পটির ৭৫ শতাংশ ঋণ সংস্থান হবে চীন থেকে। ঋণের পরিমাণ এক দশমিক ৭৩৯ বিলিয়ন ডলার। দুটি চীনা কোম্পানি সেপকো থ্রি ইলেক্ট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ এস আলমের সঙ্গে যৌথভাবে বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে কাজ করছে। মোট শেয়ারের ৭০ শতাংশ থাকছে এস আলম গ্রুপের কাছে। সেপকোর কাছে থাকছে ২০ শতাংশ এবং এইচটিজি ডেভেলপমেন্টের হাতে থাকছে ১০ শতাংশ শেয়ার। সেপকোই প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। গত বছরের ২৯ জুন সেপকোর সঙ্গে চুক্তি হয় তাদের। কেন্দ্রের মূল যন্ত্রাংশও সরবরাহ করবে সেপকো। অন্যদিকে সঞ্চালন ও বিতরণের দুই প্রকল্পে চীনা এক্সিম ব্যাংক পিজিসিবি ও ডিপিডিসিকে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়নে পিজিসিবি এক দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সঞ্চালন ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। পিজিসিবিকে সেই লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী চুক্তি সইয়ের পর জনকণ্ঠকে বলেন, ঋণের অর্থে ৭৬৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণ করা হবে। এর বাইরে আরও ৩০০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে ৪১ এছাড়া পুরান ৫৪ সাবস্টেশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। ঢাকার বিদ্যুত ব্যবস্থা উন্নয়নে এক দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিচ্ছে ডিপিডিসি। এই ঋণের অর্থেই ঢাকার দুটি এলাকার বিতরণ লাইন চলে যাবে ভূগর্ভে একই সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সাবস্টেশনও নির্মাণ করবে ডিপিডিসি। হাতিরঝিলের নান্দনিকতা ফিরিয়ে দিতে এই এলাকা দিয়ে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন মাটির নিচে দিয়ে নেয়া হবে। সংস্থার পরিচালক (প্রকৌশল) রমিজ উদ্দিন সরকার চুক্তি সইয়ের পর জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকার হাতির ঝিলের লাইনের পুরোটা চলে যাবে মাটির নিচে আর ধানম-ি এলাকার লাইনকেও আন্ডারগ্রাউন্ডে নেয়া হবে। তিনি বলেন, ৩৩/১১ কেভির ৪০ নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে। এতে এখানকার যে বিদ্যুত বিড়ম্বনা দূর হবে। এর বাইরে আধুনিক ট্রেনিং সেন্টার এবং কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মণের প্রকল্প রয়েছে। এই ভবনগুলোর নিচে বসানো হবে সাবস্টেশন বাংলাদেশে যা প্রথম। বিপিসি জ্বালানি তেল পরিবহনে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল নির্মাণ করছে। এ বিষয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তি সই হয়েছে শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরে। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, এটি মূলত আনুষ্ঠানিকতা। তবে এর আগেই বিপিসি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল নির্মাণে এমওইউ সই করেছে। এখন সরকারের ক্রয় কমিটির অনুমোদন পেলেই চূড়ান্ত চুক্তি হবে। চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণ করা হবে। টার্মিনালটি নির্মাণ করা হলে গভীর সমুদ্র থেকে বিপিসির ডিপোতে তেল আনা হবে পাইপ লাইনে। লাইটারেজের কোন প্রয়োজন হবে না।
×