ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে কোন দুর্যোগ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

যে কোন দুর্যোগ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে এখন অনুসরণ করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। রামপালে বিদ্যুতকেন্দ্রকে ঘিরে সবুজ বেষ্টনী সৃষ্টি ও কার্বন সিংকের জন্য সেখানে লাগানো হবে ৫ লাখ গাছ। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০১৬ উপলক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী জনগণকে যে কোন দুর্যোগ সাহসের সঙ্গে মোকাবেলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আগামীতে কোন দুর্যোগেই যেন জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সম্ভাব্য সকল ধরনের পদক্ষেপ নেবে সরকার। আমাদের লক্ষ্য যে, যে কোন দুর্যোগ আসবে সেই দুর্যোগকে আমাদের সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে এবং দুর্যোগ থেকে মানুষকে আমাদের বাঁচাতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোন দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের জনগণ সর্বদা প্রস্তুত থাকবে। ঝড়ঝাপ্টা আসবেই এবং সেটা মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা আল্লাহর রহমতে এখন বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। আগামীতে কখনও এই বাংলাদেশের মানুষ যেন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যবস্থা অবশ্যই আমরা নেব। তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের দুর্যোগ মোকাবেলার পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থল থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নবনির্মিত ১৫৩টি আশ্রয় কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ শাহ কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ সম্ভুু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ রিয়াজ আহমেদ। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাইক্লোন রোয়ানু ক্ষতিগ্রস্ত মোঃ শহীদুল আলম এবং গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সাম্প্রতিক বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত মাসুদা বেগম দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নিজস্ব অভিজ্ঞতা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন। আলোচনা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবসের প্রতিপাদ্য ‘টেল টু লিভ’। এর সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশে প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়, ‘দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে হলে, কৌশলসমূহ বলতে হবে’। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দিবসটি উপলক্ষে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় আয়োজন করা হয়েছে ভূমিকম্প ও অগ্নি প্রতিরোধ মহড়া। প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা এমন এক জায়গায়, যেখানে প্রতিনিয়ত নানা ঝুঁকির মোকাবেলা করেই আমাদের চলতে হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশকেই বেশি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ঝড়, বন্যা আমাদের দেশে লেগেই থাকে। আমি এটুকু বলব- উত্তরবঙ্গের মঙ্গা আমরা দূর করেছি। এখন নদীভাঙ্গন ও বন্যা থেকে আমাদের জনগণকে রক্ষা করার জন্য নির্দেশ হচ্ছে-যেসব ঘরবাড়ি করা হচ্ছে তা একটু উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে। মানুষের যেন ক্ষতি না হয় সেটা দেখা হবে। সত্তরের জলোচ্ছ্বাস, ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯৮ সালের বন্যার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। জাতির পিতা সেদিন নির্বাচনী প্রচার বন্ধ রেখে ছুটে গিয়েছিলেন বিপন্ন-অসহায় মানুষের পাশে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনিই ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় গঠন করেন। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে তখনকার বিএনপি সরকারের ‘অসচেতনতার’ সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সতর্ক বার্তাটাও সেভাবে দেয়া হয়নি। ঘূর্ণিঝড়টা কীভাবে আসছে, কত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টা হবে- তখন আবহাওয়া বার্তা দেয়ার মতো আধুনিক পদ্ধতিও ছিল না। ফলে এ ব্যাপারে কোন সচেতনতা ছিল না, কেউ জানত না। সে সময় নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর ‘ব্যাপক’ ক্ষয়ক্ষতির কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সরকার অসচেতন থাকলে, কেউ তো সচেতন হয় না। দুর্যোগ মোকাবেলায় এখনকার প্রস্তুতি তুলে ধরে তিনি বলেন, এখন মাল্টিপারপাস সাইক্লোন শেল্টার বানাচ্ছি। সেখানে স্কুল হবে, হাসপাতাল হবে বা অন্য দফতর হবে। প্রত্যেকটা সাইক্লোন শেল্টারের সঙ্গে একটা স্টোরের ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে স্কুল বা অফিস যা চলবে, তাদের জরুরী কাগজ যেন রাখা যায়। প্রত্যেক সাইক্লোন শেল্টারে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা হবে। গবাদিপশু রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং মেরামতের তথ্যও অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বজ্রপাত থেকে রক্ষায় তালগাছ লাগানোর ওপর জোর দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বজ্রপাত ইদানীং দেখা যাচ্ছে খুব বেশি। আগে প্রত্যেক বাড়ির সঙ্গে তালগাছ থাকত। ইদানীং তালগাছ নেই। তালগাছ কেউ লাগায় না। তালগাছের একটা গুণ আছে। বজ্রপাত হলেই সেটা আগে তালগাছের ওপর পড়ে। আমাদের দেশ থেকে যেন তালগাছ হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের আবার তালগাছ লাগানো শুরু করা উচিত। দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতির পিতার গৃহীত পদক্ষেপের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের পহেলা জুলাই দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ঝুঁকিহ্রাসের লক্ষ্যে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি)’ গঠন করেছিলেন। দুর্যোগকালে গবাদিপশুর আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহƒত উপকূলীয় এলাকায় বঙ্গবন্ধুর আমলে নির্মিত ১৫৬টি মাটির কিল্লা এখনও ‘মুজিব কিল্লা’ নামে পরিচিত ও ব্যবহƒত হচ্ছে। তিনি বলেন, দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসের জন্য আমরা ৩ হাজার ৮৫১টি সাইক্লোন শেল্টার, ৭৮টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। ১৫৬টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ চলমান রয়েছে। জরুরী উদ্ধার কাজে সহযোগিতার জন্য ফায়ার সার্ভিসের আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১ম পর্যায়ে ৬৯ কোটি এবং ২য় পর্যায়ে ১৫৮ কোটি টাকার সরঞ্জামাদি ক্রয় করে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে হস্তান্তর করা হয়েছে। দুর্যোগকালীন জনসাধারণকে নিরাপদ অবস্থানে স্থানান্তরের জন্য সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ হাজার ব্রিজ-কালর্ভাট নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের উদ্যোগের ফলে ২০১৩ সালের ‘ঘূর্ণিঝড় মহাসেন’-এ মারা যায় ১৭ জন, ২০১৫ সালের ‘ঘূর্ণিঝড় কোমেনে’ মারা যায় ১ জন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে’ ২৭ জন মারা যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কাছে প্রতিটি জীবনই মহামূল্যবান। কাজেই ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার লক্ষ্যে আগামী ৫ বছরে সাইক্লোন শেল্টারের সংখ্যা আমরা ৬ হাজারে উন্নীত করব এবং ইভাকুয়েশন পদ্ধতিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাই। তিনি বলেন, ’৯৮’র বন্যায় আমি নিজ হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কাফেটারিয়ায় রুটি বানানোর পর এই কর্মসূচী সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয়। আমাদের জনগণকে একটি বিষয়ে একবার জাগিয়ে তুলতে পারলে বিজয় নিশ্চিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই বন্যায় ৬৯ দিন দেশ পানিতে তলিয়েছিল। আন্তর্জাতিক নামকরা গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, বাংলাদেশে ২ কোটি লোকের প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে। কিন্তু আমরা তা হতে দেইনি। দ্রুত মানুষের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচার জন্য উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ এবং সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে দুর্যোগ সহনশীল কার্যক্রম উন্নয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন নিশ্চিত করা যাবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণ সম্ভবপর হবে।
×