ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাঙ্গাপীড়িত উত্তর প্রদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১২ অক্টোবর ২০১৬

দাঙ্গাপীড়িত উত্তর প্রদেশ

ভারতের উত্তর প্রদেশের মোজাফফর নগরে ২০১৩ সালের দাঙ্গায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তারা আজও শোচনীয় অবস্থায় জীবনযাপন করছে। বেশিরভাগ মানুষের পুনর্বাসন ও ন্যায়বিচার লাভ তো দূরের কথা বরং তাদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে। তাদের দুর্ভোগের পরিমাপ করা যায় এই বাস্তবতা থেকে যে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় অর্ধেক সংখ্যক নরনারী এখনও উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে মানবেতর পরিবেশে বাস করছে, যেখানে পানি নেই, বিদ্যুদ নেই, স্বাস্থ্য রক্ষার ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু নেই। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মোজাফফর নগরের সেই দাঙ্গায় ৬০ জনেরও বেশি নিহত এবং প্রায় ১ লাখ নরনারী শিশু বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। অবশ্য বাস্তুচ্যুতদের কিছু অংশকে আপনা ঘর কলোনিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। কলোনিটি অল্প কিছুদিন আগে উদ্বোধন করা হয়। এটি হচ্ছে নাগরিক সমাজ সংগঠন ও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের যৌথ উদ্যোগের ফসল। তাদের নেয়া ‘ইয়ে মেরা ঘর’ প্রকল্পের মাধ্যমে যাদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে তারা নতুন আঙ্গিকে ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো ঘর। এ উপলক্ষে কিছু কিছু দাঙ্গাপীড়িত ফিরে এসেছে আপন গ্রামে। অনেকে ভয়ভীতি থেকে ফিরে আসতে রাজি হচ্ছে না। উত্তর প্রদেশে সরকার মুজাফফর নগরের দশটি গ্রামকে দাঙ্গায় সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ঘোষণা করে। এসব গ্রামের গৃহহারা পরিবারগুলোকে পাঁচ লাখ রুপী ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। বিনিময়ে তাদের এই এফিডেভিটে সই দিতে হয় যে তারা আর গ্রামে ফিরে যাবে না। সেই দাঙ্গার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন বলেন যে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে ভালবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল। আক্রান্তরা কোথায় পালিয়ে যাবে সে ব্যাপারেও তাদের কোন ধারণা ছিল না। পরবর্তীকালে যাদের শিবিরে ঠাঁই হয়েছিল তাদের নিয়ে নানা মানবিক কাহিনী পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। শামলি জেলায় প্রচ- শীতে কয়েক উদ্বাস্তু মারাও যায়। রাজ্য সরকার এক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে তিন দিনের মধ্যে শিবির ছাড়তে বাধ্য করলে ২৩০টি পরিবার একত্রিত হয়ে ওই টাকায় জমি কেনে। কিন্তু বাড়ি তোলার মতো সঙ্গতি না থাকায় ‘ইয়ে মেরা ঘর’ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় সাহায্য সংস্থার লোকেরা। তারা অর্থ যুগিয়ে তিনটি স্থানে এদের আবাসনের ব্যবস্থা করেÑ কান্দলার মানাকপুর, কাইবানার আরিয়াপুরি এবং বসিকালান। এই তিন স্থানে ২১৯টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। আর যাদের আবাসনের ব্যবস্থা হয়নি তারা আশ্রয় নিয়েছে কাইবানা গ্রামের জমিয়াত কলোনিতে। সেখানে ঠাঁই হয়েছে প্রায় ৩শ’ পরিবারের যারা বিভিন্ন সময়ে হামলার শিকার। এদের জীবন অতি দুর্বিষহ পানি নেই, বিদ্যুত নেই। এমন অবস্থা চলছে প্রায় তিন বছর ধরে। এদের প্রতি প্রশাসনের উদাসীনতা যে কি প্রকট তা শিবিরগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। যেমন, বিকলাঙ্গ ফিরোজ খান মোজাফফর নগর প্রশাসনের কাছ থেকে বছরে ১৮শ’ রুপী করে ভাতা পেত। এই তিন বছর ধরে সে তা-ও পাচ্ছে না। তার স্ত্রীর সম্প্রতি বাচ্চা হয়েছে। তাতে পরিবারের সমস্যাটা আরও বেড়েছে। পাঁচ বছরের এক ছেলে আছে। প্রচ- গরমে ঘুমোতে না পেরে খালি কাঁদে। মা সারারাত হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে। আক্ষেপ করে ফিরোজ। বলে সে আসলে এই গরমে কেউ ঘুমাতে পারে না। শিবিরের আরেক বাসিন্দা ৪৫ বছরের বিধবা নাসরিন। দাঙ্গার সময় আশপাশের তল্লাটের পাঁচ দাঙ্গাবাজ তাঁকে গণধর্ষণ করেছিল। এখনকার রূঢ় বাস্তবতা তার কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো। মহিলা দিনমজুরের কাজ করে আট ছেলেমেয়েকে নিয়ে কোনভাবে দিন গুজরান করে। জীবন তার কাছে অভিশাপ ছাড়া আর কিছু নয়। নাসরিন বিলাপ করে বলে যে যেখানে অভিযুক্তরা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়েছে, সেখানে রাজনীতিকরা এই দাঙ্গা থেকে ফায়দা লুটিয়েছে সেখানে তার মতো যারা দাঙ্গার শিকার তারা আর চলতে পারছে না। কয়েকটি এনজিওর জরিপের ভিত্তিতে প্রণীত এক রিপোর্টে সম্প্রতি অভিযোগ করা হয়েছে যে দাঙ্গা বাস্তুচ্যুতদের দ্রুত পুনর্বাসন এবং অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার পরিবর্তে প্রশাসন বরং হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অবাধে বিচরণের সুযোগ দিচ্ছে। হত্যার বেশিরভাগ মামলা বিচার না করে কিংবা চার্জশীট দাখিল ছাড়াই ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে। আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে ভিকটিমদের ওপর প্রবল চাপ দেয়া হচ্ছে। গোড়াতে ৫৩৪টি এজাহারে ৬৪০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। ছয় মাস পর এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা কমে এসে ৩ হাজার ৩২৫৪তে দাঁড়ায় এবং এক বছর পর তাও নেমে আসে ৮শ’তে। এতে করে দাঙ্গার সময় যারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিল তাদের আতঙ্কে ইন্ধনই যোগানো হয়েছে মাত্র। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে ও ইন্টারনেট
×