ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিমা বিসর্জনে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১২ অক্টোবর ২০১৬

প্রতিমা বিসর্জনে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লোকালয় থেকে বিদায় নিচ্ছেন দেবী দুর্গা। হয় তো এ কারণেই বিকেলে মুখ ভার ছিল আকাশের। অবশ্য বিদায়ের প্রস্তুতি শুরু হয় সকাল থেকেই। মুখে পান পাতা বুলিয়ে, সিঁদুর ছুঁইয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে সারা হয় আনুষ্ঠানিকতা। বিষাদের সুর বাজে ম-পে ম-পে। শেষ পর্যন্ত ভক্তের মনে মেঘ আর আকাশে বিষাদের ঘন মেঘ জমিয়ে বিদায় নেন দুর্গতিনাশিনী। তবে বিষাদের মাঝেও ভক্তমনের সান্ত¡না- মঙ্গলময় বার্তা নিয়ে সামনের বছর আবার আসবেন দেবী। এই আশার মধ্য দিয়েই শেষ হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মঙ্গলবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় পাঁচ দিনব্যাপী এই আয়োজন। ভক্তদের চোখের জলে ভাসিয়ে এদিন সপরিবারে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা বাবার বাড়ি থেকে ফিরে গেলেন স্বামীর ঘরে কৈলাসে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসার মতো আসুরিক প্রবৃত্তি বিসর্জন দেয়াই মূলত বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসেন এবং স্বর্গালোকে বিদায় নেন ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে। যার ফল হচ্ছে রোগ, শোক, হানাহানি-মারামারি বাড়বে। তবে ভক্তদের বিশ্বাস, মঙ্গলময়ী ও আনন্দময়ী দেবী দুর্গা সবার কল্যাণই করবেন। দেবীর বিদায়ের আয়োজন শুরু হয় সকাল থেকে। ম-পে ম-পে করা হয় দশমী পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন। বিষাদের সুর ছিল ঢাক-ঢোল, কাঁসর-ঘণ্টাসহ বিভিন্ন বাদ্যে, ছায়া ছিল আলোকিত করা ধূপ আরতিতে এবং দেবীর পূজা-অর্চনায়। বিসর্জনের আগে সকাল থেকে ঢাকার মন্দিরে মন্দিরে চলে সিঁদুর খেলা আর আনন্দ উৎসব। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য মঙ্গলবার বঙ্গভবনে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। তিনি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। প্রতিমা বিসর্জনের উদ্দেশে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গন থেকে কেন্দ্রীয় বিজয়া শোভাযাত্রা বের হয়। গতকাল দুপুরে পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে বের হয় বর্ণাঢ্য এই বিজয়া শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি পলাশী মোড় থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে গিয়ে পৌঁছে। ঢাকের শব্দে আর ধূপের গন্ধে মুখরিত হয়ে উঠে ওয়াইজঘাট এলাকা। বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জনে অংশ নিতে দুপুর গড়িয়ে যেতেই ভক্তরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজাম-প থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে। বিদায়ের বিষাদ জাগে আকাশে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের পূজাম-প থেকে আসা প্রতিমা নিয়ে ট্রাকগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায় রাস্তায়। বৃষ্টির আশঙ্কা সত্ত্বেও বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ নেচে-গেয়ে শোভাযাত্রাকে আরও বর্ণিল করে তোলে। অধিকাংশ ম-পের প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হলেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমাটি রেখে দেয়া হয়। কিন্তু পূজার কাজে ব্যবহৃত দেবীর ফুল, বেলপাতা ও ঘট বিসর্জন দেয়া হয়। বিশাল এ শোভাযাত্রা এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে লোক সমাগম ও ট্রাকে প্রতিমার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিমা নিয়ে মিছিলে যোগ দিতে থাকেন ভক্তরা। যাত্রাপথে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পুলিশ সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখে। বিপুলসংখ্যক পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব সদস্যরাও মাঠে ছিলেন। এ সময় বুড়িগঙ্গার দুই তীরে হাজারও ভক্ত ও দর্শনার্থী প্রতিমা বিসর্জন দেখতে ভিড় করেন। অনেকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় নৌকায় করে নদীতে আনন্দ করে। এ উপলক্ষে গতকাল ওয়াইজঘাট এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। আহসান মঞ্জিলের পাশে বিণা স্মৃতি স্নান ঘাটে এ বছর প্রথম প্রতিমা বিসর্জন দেয় টিকাটুলির পূজাম-প ভোলা নাথ নন্দগিরি। রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ধ্যা আরতির পর মিশনের পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। এরপর ভক্তরা শান্তিজল গ্রহণ করেন ও মিষ্টিমুখ করেন। প্রথা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনের পর সেখান থেকে শান্তিজল নিয়ে আসা হবে। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এবার সারা দেশে ২৯ হাজার ৩৯৫ স্থায়ী, অস্থায়ী ম-পে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। যা গত বছরের তুলনায় ৩২৪ বেশি। আর রাজধানী ঢাকায় পূজা অনুষ্ঠিত হয় ২২৯ ম-পে। রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ॥ রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহ্য। তিনি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। দুর্গা পূজা উপলক্ষে বঙ্গভবনে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, পূজা ও অন্যান্য উৎসব বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিক গভীর থেকে উদ্ভূত। রাষ্ট্রপতি দুর্গা পূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য মঙ্গলবার বঙ্গভবনে এই সংবর্ধনার আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও তার পতœী রাশিদা খানম অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, ধর্ম সম্প্রদায়ের, কিন্তু উৎসব সার্বজনীন। ‘সকল ধর্মের মূল মন্ত্র মানব কল্যাণ’ বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং বিভিন্ন পূজা কমিটির নেতৃবৃন্দ যোগ দেন। অনুষ্ঠানে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাও উপস্থিত ছিলেন।
×