ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

পবিত্র আশুরার তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১২ অক্টোবর ২০১৬

পবিত্র আশুরার তাৎপর্য

মুহর্র্ম মাসের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। প্রাচীনকাল থেকেই আশুরা পালিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে ইয়াহূদীদের মধ্যে আশুরার সিয়াম পালন রীতি ব্যাপকভাবে ছিল। হাদিস শরীফে এই দিবসের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুকাররমের হেরা গুহায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে অবস্থানরত অবস্থায় প্রথম ওহী লাভ করেন। এর তিন বছর পর আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁকে তওহীদের বাণী প্রকাশ্যে প্রচার করতে প্রত্যাদেশ প্রদান করেন। তখন থেকে তিনি প্রচারকার্যে তৎপর হন। মক্কার কাফির মুশরিকরা একজোট হয়ে তাঁর প্রচারকার্যে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শত বাধা উপেক্ষা করে কিছু সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলামে দাখিল হন। এক পর্যায়ে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হিজরত করলেন। এখানে তশ্্রীফ এনে তিনি জানতে পারলেন এখানকার ইয়াহূদীরা আশুরাতে সিয়াম পালন করে। তিনি তাদেরকে ডেকে জানতে চাইলেন তারা কেন আশুরাতে সিয়াম পালন করে। তারা বললেন : যেদিন নবী হযরত মূসা (আঃ) ফেরাউনের কারাগার থেকে বনী ইসরাঈলকে মুক্ত করে দরিয়া পাড়ি দিয়েছিলেন সেদিন ছিল আশুরা। তাই কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ তিনি আশুরার দিনে সিয়াম পালন করতেন এবং আমরাও তাঁর অনুসরণে এদিনে সিয়াম পালন করি। এ কথা শুনে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন : তোমাদের চেয়ে মূসার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেশি এবং অতি নিকটতর। এর কয়েক মাস পরে মুহর্রম মাস এলে তিনি আশুরাতে সিয়াম পালন করলেন। তাঁর অনুসরণে সাহাবায়ে কেরামও আশুরার সিয়াম পালন করলেন। এর প্রায় ৭ মাস পরে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু রমাদান মাসকে সিয়ামের জন্য নির্ধারিত করে দিয়ে সিয়াম বিধান নাযিল করলেন। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : রমাদান মাস যাতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য দিশারী, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্যকারী আল কুরআন। সুতরাং তোমরা যারা এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা এতে সিয়াম পালন করবে (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৪)। রমাদানের সিয়াম ফরজ হয়ে গেলে আশুরার সিয়াম নফল সিয়াম হয়ে যায়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : নফল সিয়ামের মধ্যে উত্তম সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম। তখন থেকে আশুরার সিয়াম গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। আশুরা ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা’য়ালা আনহুর কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদাত লাভের কারণে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুহররম মাসের আগমনকে স্মরণ করেছেন এইভাবে : ফিরে এলো আজ সেই মোহর্রম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা/উষ্ণীষ কোরানের, হাতে তেগ আরবীর/দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,/তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা,/শমশের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!... উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক মহান নকীব মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর বলেন : কত্লে হুসাইন আসলমে মর্গে ইয়াযীদ হ্যায়/ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায় র্হ্ কারবালা কি বা’দ। মূলত আশুরা সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী। জানা যায়, বিশ্বজগত সৃষ্টি হয়েছিল আশুরাতে, হযরত আদম আলায়হিস্্ সালামের দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল আশুরাতে, তাঁকে সস্ত্রীক পৃথিবীতে অবতরণ করা হয়েছিল আশুরাতে, তিনি শ্রীলঙ্কার একটি পর্বতচূড়ায় এবং তাঁর স্ত্রী বিবি হাওয়া আলায়হাস্্ সালাম আরবের জেদ্দায় অবস্থান করে প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর তওবা করেন। তাঁরা এই সময় আল্লাহ্্র নিকট তওবা করেন এই বলে : হে আমাদের রব্। আমরা আমাদের নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন তাহলে আমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওসিলায় তাঁদের দু’আ কবুল করেন। তাঁরা দীর্ঘ সাড়ে তিন শ’ বছর পর আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হন এবং বাক্কা বা মক্কা এসে বসবাস করতে থাকেন। হযরত আদম আলায়হিস্্ সালাম ইন্তিকাল করেন এক আশুরাতে। পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টিপাত হয়েছিল কোন এক আশুরাতে। হযরত নূহ (আঃ) মহাপ্লাবনে ৪০ দিন কিশতিতে ভাসমান থাকার পর যূদী পাহাড়ে অবতরণ করেছিলেন। হযরত ইব্্রাহিম আলায়হিস্্ সালাম নমরুদের অগ্নিকু- হতে নিরাপদে উদ্ধার পেয়েছিলেন, হযরত ইউনুস আলায়হিস্্ সালাম মাছের পেট থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন, হযরত ইউসুফ আলায়হিস সালাম দীর্ঘকাল পর পিতা ইয়াকুব আলায়হিস সালামের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। হযরত সুলায়মান আলায়হিস্্ সালাম হারিয়ে যাওয়া সাম্রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন, হযরত আইয়ূব আলায়হিস্্ সালাম ১৮ বছর পর কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন আশুরাতে। আশুরাতে বিভিন্ন নবীর উম্মতগণ সিয়াম পালন করতেন। ইয়াহূদীরা ১০ তারিখে সিয়াম পালন করে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মুহররমের নবম ও দশম তারিখে সিয়াম পালনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আশুরার দিনে সিয়াম পালনের গুরুত্ব বেশি। জানা যায়, ভবিষ্যতে কোন এক আশুরার শুক্রবার কিয়ামত হবে। লেখক : পীরসাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×