ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ এমদাদুল ইসলাম

আবাসিক এলাকায় অনাবাসিক কার্যক্রম করতে হবে নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৪ অক্টোবর ২০১৬

আবাসিক এলাকায় অনাবাসিক কার্যক্রম করতে হবে নিয়ন্ত্রণ

গুলশান আবাসিক এলাকার ভিআইপি জোনের অভ্যন্তরে স্থাপিত হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে গত ১ জুলাই রাতে কিছু বিপথগামী তরুণের আক্রমণে ২ পুলিশ অফিসারসহ ২২ জন দেশী-বিদেশী নাগরিককে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে নতুন করে আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। এই বর্বর ঘটনাউত্তর গতানুগতিক নিয়মে তথাকথিত জঙ্গী সংগঠন ‘আইএস’ এর দায়-দায়িত্ব স্বীকার করে বিবৃতি দিলেও বাস্তবে এ নিয়ে বড় ধরনের রহস্যময়তার সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে আগে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হত্যাকা- ঘটলেও বাস্তবে কে বা কারা এসব ঘটিয়েছে, এতদিন সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি, যদিও এ নিয়ে দেশের পরস্পরবিদ্বেষী রাজনীতিতে ব্লেমগেম চলছে। কিন্তু এবার হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা গেছে। হত্যাকারীরা সকলে সমাজের শিক্ষিত ও উঁচুঘরের সন্তান। লক্ষণীয় যে, হত্যাকারীদের প্রায় সকলে দেশ-বিদেশে ভাল স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন এবং তাদের এই অপকর্মের পরিকল্পনাও হয়েছিল নগরীর অভিজাত এলাকায় বসে। তাদের আড্ডাস্থল ছিল এসব অভিজাত এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে বা কারও না কারও বাসায়। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তর গুলশানস্থ ৭৯ নং সড়কের লেকপাড়ে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টটিতেও এদের নিয়মিত আড্ডা হতো এবং এতে নিত্যদিন বিদেশীদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে সেদিন ওই ঘটনাটির পরিকল্পনা করা হয়। ঐ ঘটনাউত্তর গুলশান-বনানী-বারিধারাসহ নগরীর অপরাপর সব সরকারী-বেসরকারী পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার জীবনযাত্রায় ছেদ পড়েছে। সকল প্রবেশপথে কঠোর পুলিশী নিয়ন্ত্রণ চলে, বেশিরভাগ হোটেল ও গেস্ট হাউস খালি হয়ে যায়, ক্যাফে ও রেস্টুরেন্টগুলোতে কাস্টমার শূন্যতা দেখা দেয়। এ এলাকায় অবস্থিত হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য অফিসগুলোও ঠিকমতো চলেনি। কূটনৈতিক এলাকা ও নগরীর সকল আবাসিকের মধ্যে এক ধরনের ভয়-আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। জরুরী কাজকর্ম না হলে অনেকে বিশেষ করে বিদেশী নাগরিকরা ঘর থেকে বেরও হয়নি। এবার একটু এ বিষয়ের গভীরে দৃষ্টি দেয়া যাক। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় দেশের মধ্য থেকে উচ্চবিত্তদের আবাসনের জন্য ষাটের দশকে তৎকালীন নগরীর প্রান্তসীমায় এসব আবাসিক এলাকাগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। তন্মধ্যে ধানম-ি-লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর, গুলশান-বনানী-বারিধারা ও উত্তরা অন্যতম। শুরুতে নামমাত্র মূল্যে এ প্রকল্পগুলোতে প্লট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা হয়। ধানম-ি এলাকায় জমির কাঠাপ্রতি মূল্য ছিল ৫০০ টাকা এবং গুলশান-বনানীতে ৭৫০ টাকা। কিন্তু মূল শহরের বাইরে এ প্রকল্পগুলোতে প্রথমদিকে খুব কম মানুষই প্লট বরাদ্দ গ্রহণে আগ্রহী ছিল। কারণ এ প্রকল্পগুলোর বড় দুর্বলতা ছিল- আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিকল্পিত বিধায় এখানে কোন বাণিজ্যিক প্লটের সংস্থান রাখা হয়নি, যদিও পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বাণিজ্যিক প্লটের সংস্থান করা হয়। আসলে এখানে আমাদের নগর পরিকল্পনার দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বিবেচনা করেননি- এসব আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী মানুষগুলো কোথা থেকে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবাদি পাবে। যেমন পাকিস্তান আমলের শুরুতে পরিকল্পিত ধানম-ি এলাকার মূল পরিকল্পনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে কোন কাঁচাবাজার, মার্কেট, স্কুল, ক্লিনিক ইত্যাদির সংস্থান নেই। প্রায় একই অবস্থা পরবর্তী সময়ে পরিকল্পিত গুলশান-বনানী আবাসিক এলাকায়ও। ফলে এসব এলাকায় মানুষের বসবাস শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সেবা লাভে আপনাতে স্থানে স্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠতে থাকে। যার কিছু পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে বৈধ করে দেয়ার পর, এর রেশ ধরে বিশেষ করে একটি প্লট একটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ দেয়ার পর সেখানে আবার বহুতল ভবন নির্মাণ ও এ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসার সুযোগ করে দেয়ার প্রেক্ষিতে বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে এসব আবাসিক এলাকায় বৈধ-অবৈধভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবণতা অত্যধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। আবার এও সত্যি যে, এসব আবাসিক এলাকা বাসস্থানের বিবেচনায় পরিকল্পিত বিধায় সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার নিমিত্তে পরিকল্পনায় যৎসামান্য বাণিজ্যিক প্লটের সংস্থান রাখা হলেও সেগুলো শুরুতে বরাদ্দ করা হয়নি। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর নগরীতে বর্ধিত জনগণের আবাসনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ধানম-ি-লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুর,্ গুলশান-বনানী ও উত্তরায় অবশিষ্ট অবরাদ্দকৃত আবাসিক ও সংরক্ষিত বাণিজ্যিক প্লটগুলোতে সরকারীভাবে ইমারত নির্মাণ করে তা বরাদ্দ দেয়ার নির্দেশ প্রদান করা সত্ত্বেও তা স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে কার্যকর হয়নি। আসলে স্বাধীনতার পর প্রথম থেকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হলে নিশ্চয়ই এসব এলাকায় আজকের এই ‘ফ্রি স্টাইলে উন্নয়ন’ হতে পারত না। জানা মতে, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এসব এলাকায় কাউকে কোন আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লটের বরাদ্দ বা আবাসিক ইমারতে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়নি। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলেও এর কোন বিচ্যুতি ঘটেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে এই অপকর্মটি শুরু হয় স্বৈরশাসক খ্যাত জেনারেল এরশাদের শাসনামলে। তাঁর সামরিক থেকে বেসামরিক সরকার গঠনে রাজনীতিবিদ তথা বিভিন্ন ধরনের স্বার্থান্বেষী লোকজনকে ’কেনা-বেচা’ করে দল ভারি করতে ওহপবহঃরাব বা ঈড়হপবংরড়হং দিতে গিয়ে ধানম-ি ও গুলশান-বনানী-বারিধারায় প্লট বরাদ্দ, বহুতল ভবনের নকশা অনুমোদন এবং বিদ্যমান আবাসিক প্লট/ইমারতে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থাকরণে পূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউককে বাধ্য করা হয়। কিছু রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী এত বেপরোয়া হয়ে যায় যে, তাদের কেউ কেউ গুলশান-বনানীতে ৬ তলার অনুমোদন নিয়ে ১২-১৪ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করে বসেন। এভাবে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাণিজিক ও পরিবর্তিত উভয় ধরনের প্লটের ক্ষেত্রে কমবেশি সকলে বিধি-বিধান উপেক্ষা করে প্রায় শতভাগ জমির ওপর ইমারত নির্মাণ ও ইচ্ছেমতো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এসব আবাসিক এলাকায় ইতোমধ্যে অনেক প্রাইভেট ব্যাংক-বীমার সদর দফতরসহ মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিসমূহের অফিস থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্থাপিত হয়ে বসে। আর রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, কোচিং সেন্টার, স্কুল, অফিস ইত্যাদি তো এখন প্রায় ঘরে ঘরে। ঢাকায় ইমারত নির্মাণের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে রাজউকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব অবৈধ ও অননুমোদিত নির্মাণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বন্ধকরণে (প্লট ও ইমারতের অনুমোদন বাতিলের) কিছু চেষ্টা চালানো যে হয়নি তা নয়, কিন্তু লাভ হয়নি। কোন একটা ইমারত বা স্থাপনায়ও পর্যাপ্ত কার পার্কিং স্পেস নেই। যেসব ইমারতে বেসমেন্ট আছে তাও অন্য ব্যবহারে চলে গেছে। এভাবে ইমারতের অভ্যন্তরে পার্কিং স্পেসের অভাবে সংলগ্ন সড়কের ওপর গাড়ি পার্কিং করে রাখার কারণে সড়কে যানজটের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পরিকল্পিত এলাকা হয়েও এখানে এখন আর কেউ নির্বিঘেœ বসবাস ও চলাচল করতে পারছে না। উদ্ভূত অবস্থায়, নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করত যথাসম্ভব বসবাসযোগ্য করার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে- কার নেতৃত্বে ও কিভাবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি পরিচালিত হবে? তাছাড়া সিদ্ধান্তটি কী শুধু পরিকল্পিত বা সরকারী প্লটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, নাকি পুরো শহর-নগরে কার্যকর হবে তাও অস্পষ্ট। দেশে ‘আবাসিক’ এলাকার সংজ্ঞাটিও অস্পষ্ট। আবাসিক এলাকা বা শহর বলতে শুধু কি সেখানে আবাসিক প্লট থাকবে ও লোকজন বসবাস করবে, নাকি অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবারও সংস্থান থাকবে তা পরিষ্কার নয়। লক্ষণীয় যে, ইতোপূর্বে অনুরূপ অস্পষ্টতায় আরও অনেক সরকারী নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে গৃহীত না হওয়ায় তা বাস্তবায়িত হয়নি বা অনেক দীর্ঘ সময়ও লেগে যায়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। যে কারণে হাজারীবাগ এলাকা থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তরের জন্য প্রায় এক যুগ আগে সিদ্ধান্ত হওয়াসহ দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে এখনও বিষয়টি কার্যকর হয়নি। তাই আলোচ্য সিদ্ধান্তটির কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে কথা হচ্ছে। পাশাপাশি এও কথা হচ্ছে- এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান কোথায় স্থানান্তরিত হবে? তাদেরকে কী পরিকল্পিত এলাকা থেকে হটিয়ে অপরিকল্পিত এলাকায় বা রাজধানীর বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে? বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সর্বোপরি যে বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- রাজধানীর এসব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান থেকেই সরকার বেশি কর পায়, সুতরাং সিদ্ধান্তটি যেন সরকারের জন্য আবার বুমেরাং হয়ে না বসে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তবে আবাসিক এলাকার পরিবেশ বিঘিœত করে গণআকারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এলাকাবাসীর জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করা কোন অবস্থায় কাম্য নয়। মহাপরিকল্পনার ভূমি ব্যবহার তথা মূল বরাদ্দপত্রের শর্তানুসারে যেখানে যা হওয়ার সেখানে তাই হওয়া উচিত। মহাপরিকল্পনা ও স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় যা থাকুক না কেন, যখন যে সরকার যা চেয়েছে তাই হয়েছে। ফলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোন একটি শহর বা পৌর এলাকা মূল পরিকল্পনা মোতাবেক হয়নি। সমন্বয়হীনতায় অসামঞ্জস্যতার উন্নয়ন হয়েছে। কাজেই এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু করার আগে বিবেচ্য প্রতিটা এলাকায় সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বয়ে বিস্তারিত জরিপ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে এগোনো উচিত হবে। কে বা কারা, কখন কিভাবে তাদের প্লটের ব্যবহার পরিবর্তন করেছে, তা গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার প্রয়োজন। কারণ অনেকে তো ঈড়হাবৎংরড়হ ঋবব দিয়ে অনুমতি গ্রহণ করেছে, সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে সেভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিশ্চয় এ নিয়ে অনেক মামলারও উদ্ভব হবে এবং মামলাগুলোর ব্যয়ও ত্বরিত নিষ্পত্তি কিভাবে হবে তাও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। পুরো বিষয়টি সমন্বিতভাবে পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি সেল স্থাপন করা যেতে পারে। তবে জনস্বার্থে অবশ্যই এই সিদ্ধান্তটির বাস্তবায়ন করতে হবে, কোন অবস্থায় পিছপা হওয়া যাবে না। লেখক : নগর ও উন্নয়ন বিশ্লেষক
×