ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনন্য উচ্চতায় ধারাবাহিক তামিম

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ২ অক্টোবর ২০১৬

অনন্য উচ্চতায় ধারাবাহিক তামিম

মোঃ মামুন রশীদ ॥ একটা সময় এসেছিল বারেবারেই তার ব্যাটিং ধারাবাহিকতা নিয়ে, মনোযোগ- এমনকি সামর্থ্য নিয়ে কড়া সমালোচনা হয়েছে। দুই বছর আগে এমনও হয়েছিল তামিম ইকবালকে দল থেকে বাদ দেয়ার জোর দাবিও উঠেছিল, এমনকি দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরাও তামিমবিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ তিনি ধারাবাহিক না! অথচ এই বাঁহাতি ওপেনারই ২০১২ এশিয়া কাপে টানা চার হাফ সেঞ্চুরি করে ধারাবাহিকতার নিপুণ নিদর্শন দেখিয়েছিলেন। গত বছরও নিয়মিত বর্ষার বৃষ্টির মতো রান ঝরেছে তামিমের ব্যাট থেকে। দীর্ঘ সাড়ে দশ মাস পর বাংলাদেশ দল ওয়ানডে খেলতে নামার পরও অব্যাহত থেকেছে। প্রথম ওয়ানডেতে ৮০ রানের দারুর ইনিংস খেলেছিলেন। শনিবার সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি হাঁকালেন তিনি। আফগান বোলিংকে ধসিয়ে দিয়ে ১১৮ বলে ১১ চার ও ২ ছক্কায় ১১৮ রানের ইনিংস খেললেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি। অনেক আগে থেকেই তিন ফরমেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক রান ও সেঞ্চুরির মালিক তামিম। তবে ওয়ানডেতে এতদিন সমান ৬ শতক নিয়ে তিনি সাকিব আল হাসানের পাশাপাশি ছিলেন। এবার তাকেও ছাড়িয়ে এককভাবে তিন ফরমেটের সর্বাধিক সেঞ্চুরিয়ান হয়ে গেলেন বাংলাদেশের। যে সহে, সে রহে- দুইবছর আগে চরম সমালোচনার শিকার তামিম সব সয়ে এখন একের পর এক নতুন ও অনন্য অর্জনে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন আরও উঁচুতে। তামিমের ধারাবাহিকতা এখন বাকি ক্রিকেটারদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বার্তা দিচ্ছে- ‘ধারাবাহিকতা শিখতে চাইলে তামিমকে দেখে শেখো!’ ২০১৪ সালের সাময়িক বাজে ফর্মটা বারবারই আলোচনায় এসেছে। সে বছর ১১ ওয়ানডে খেলে মাত্র ২৬.৯০ গড়ে ২৬৯ রান করেছিলেন তিনি। ছিল মাত্র দুটি অর্ধশতক। অথচ দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ওপেনার তিনি। তাই তীব্র সমালোচনা, বিভিন্ন সামজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপসহ নিজ পরিবার নিয়েও কটূক্তির শিকার হয়েছিলেন তামিম। তবে নীরবে হজম করেছেন সব। হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন মোক্ষম জবাবটা দেবেন ব্যাট হাতেই। গত বছর ক্যারিয়ারের সফলতম বছর কাটিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো তিন ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে। আর দুর্দান্ত সাফল্যগুলো এসেছে কথিত অধারাবাহিক তামিমের নিয়মিত দুর্ধর্ষ সব ইনিংসের কল্যাণে। বিশেষ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এপ্রিলে হওয়া সিরিজে টানা দুই ম্যাচে ১৩২ ও অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংস দুটো অনেকদিনই ক্রিকেটপ্রেমীরা মনে রাখবেন। সবমিলিয়ে ১৮ ওয়ানডে খেলে ৪৬.৩৭ গড়ে ৭৪২ রান করেন তিনি ২ সেঞ্চুরি ও ৫ হাফ সেঞ্চুরিসহ। তার এমন ব্যাটিং দেখে তখন বিশ্বক্রীড়ায় প্রতিষ্ঠিত অমোঘ বাণীটাই বারবার মনে এসেছে- ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।’ যে কোন কিছুর শুরুটাই চ্যালেঞ্জিং, অস্বস্তির এবং অবশ্যই কঠিন। তবে একবার ভালভাবে মসৃণ সূচনা দিতে পারে দারুণ কোন সমাপ্তি। শুরুতে নেমে এমনটাই দেখা যাচ্ছিল। অভিজ্ঞ অফস্পিনার মোহাম্মদ নবীর করা প্রথম ওভারে কোন রানই নিতে পারেননি অস্বস্তিতে থাকা তামিম। ইনিংসের তৃতীয় ওভারের প্রথম বলেই নবীকে পুল করতে গিয়ে সহজ ক্যাচ দিয়েছিলেন মিড অনে দাঁড়ান আফগান অধিনায়ক আসগর স্ট্যানিকজাইকে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এ যাত্রা একেবারেই সহজ ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেলেন তামিম। এরপর আর সুযোগ দেননি তিনি। উইকেটে টিকে গেলে তিনি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারেন সেটার প্রমাণ পরবর্তীতে আফগান বোলাররা হাড়ে-হাড়েই টের পেয়েছে। তবে খুব বেশি আক্রমণাত্মক এবং মেজাজি ব্যাটিং দেখা যায়নি এদিন তার কাছ থেকে। জীবন ফিরে পাওয়ার পর থেকেই নিñিদ্র একটি ইনিংস খেলেছেন ধীরস্থির ভঙ্গিতে। ৬৩ বলে অর্ধশতক পেয়ে যান মাত্র ৫ চার হাঁকিয়ে। সেটাকে তিনি ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন। ১১০ বলে ১০ চারে তিনি এ শতক পেয়ে যান। এর মাধ্যমে টেস্ট ও টি২০ ফরমেটের পর ওয়ানডেতেও এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক সেঞ্চুরির মালিক বনে যান তিনি। সমান ৬ সেঞ্চুরি নিয়ে এতদিন সাকিবও ওয়ানডেতে তার পাশাপাশি ছিলেন। এ বছর টি২০ বিশ্বকাপে ১৩ মার্চ ওমানের বিরুদ্ধে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে ক্ষুদ্রতম এ ফরমেটে শতক হাঁকিয়েছিলেন তামিম। টেস্টেও সমান ৭ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। তিন ফরমেটেই এককভাবে সর্বাধিক সেঞ্চুরি ও রানের মালিক এখন তিনি। এর আগেই দ্বিতীয় উইকেটে সাব্বির রহমানের সঙ্গে ১৪০ রানের দারুণ জুটি গড়ে দলকে বড় রানের ভিত দেন তিনি। তৃতীয় উইকেটে সাকিবকে নিয়ে যোগ করেন আরও ৪৯ রান। শতক হাঁকানোর পরই দুরন্ত হয়ে ওঠেন তামিম- নিজের স্বরূপ দেখাতে শুরু করেন। রহমত শাহের করা ৩৮তম ওভারে চার হাঁকানোর পর টানা দুটি ছক্কা মারেন তিনি। তবে বেশিক্ষণ আর থাকতে পারেননি। পরের ওভারেই নবীর বলে লং-অফে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন। নবীর বলে শুরুতে বেঁচে গিয়েছিলেন, শেষটায় তামিমকে শিকার করলেন সেই নবীই। তবে বাংলাদেশ দলকে এর আগেই দারুণ এক সংগ্রহ দিয়ে গেছেন তামিম। প্রথম ম্যাচে ৮০ রান করে ফিরে গিয়েছিলেন, পরের ম্যাচে ২০। এবার যেন দুই ম্যাচের সমষ্টিকেও পেরিয়ে গেলেন। সবমিলিয়ে সর্বশেষ ১৫ ম্যাচে তামিম ৬২.০০ গড়ে ৫ ফিফটি ও ৩ সেঞ্চুরিসহ করলেন ৮০৬ রান! এরচেয়ে ধারাবাহিকতার নিদর্শন আর কি হতে পারে? দলের অন্য ব্যাটসম্যানদের জন্য দারুণ দৃষ্টান্ত ও অনুকরণের বিষয়বস্তু এখন ২৭ বছর বয়সী এ বাঁহাতি। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে ৪ হাজার রানের মালিক এখন ৫ হাজার রানের মাইলফলকেরও খুব কাছাকাছি। এখন তার ওয়ানডে রান ৪ হাজার ৯৩১। দারুণ সেই মাইলস্টোনে পৌঁছুতে প্রয়োজন আর মাত্র ৬৯ রান! তার যে ধারাবাহিকতা, তাতে করে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হবে না দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটকে। আসন্ন ইংল্যান্ড সিরিজেই হয়তো সেটা করে নিজেকে আরও অনন্য, আরও উচ্চপর্যায়ের অবস্থানে নিয়ে যাবেন, যেখানে আর কোন বাংলাদেশী কখনও যায়নি- জয়তু তামিম!
×