ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নানান মনিটরিংয়ের পরেও কারখানায় ঝুঁকিতে শ্রমিকরা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১ অক্টোবর ২০১৬

নানান মনিটরিংয়ের পরেও কারখানায় ঝুঁকিতে শ্রমিকরা

রহিম শেখ ॥ গত তিন বছর ধরে নানা মনিটরিংয়ের পর এখনও কারখানার শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই। তাজরীনে আগুনে পুড়ে শতাধিক শ্রমিক নিহত ও রানা প্লাজায় এক হাজারের বেশি শ্রমিক নিহতের ঘটনার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিষয়টি নিয়ে বেশ নাড়াচাড়া হলেও সেটা সময় গড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গেই থেমে গেছে। অনেক পোশাকশিল্পে কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে দৃশ্যত কাজ হচ্ছে বলা হলেও পরিস্থিতি খুব বেশি পাল্টায়নি। সেই একই কর্মপরিবেশ, সেই একইভাবে সরু সিঁড়ি, সেই একই অস্বাস্থ্যকর বিল্ডিং। এ তো গেল পোশাক শিল্পের কথা। এর বাইরে দেশে অনেক কলকারখানাই রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এসব কারখানার অধিকাংশই পুরানো। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নেই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বল্প পুঁজিতে বেশি মুনাফার পেছনে দৌড়াতে গিয়েই শ্রমিকদের মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন খোদ কারখানার মালিকরাই। এ কারণেই কিছুদিন পরপরই ঘটছে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনা। গত দুই দশকে শিল্প দুর্ঘটনার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এই সময়ে দুটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে পোশাক কারখানায়। অন্যটি চলতি মাসের ১০ সেপ্টেম্বর ঘটে একটি প্যাকেজিং কারখানায়। ভবন ধস ও অগ্নিনিরাপত্তা জনিত কারণেই কারখানাগুলোতে মূলত অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালে রাজধানীর অদূরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস নামের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ে মারা যান ১১২ জন শ্রমিক। ওই সময় জানা যায়, স্থাপত্য নক্সায় বড় ধরনের ত্রুটি ছিল ভবনটিতে। বহির্গমনের সিঁড়িও ছিল না নিয়ম অনুযায়ী। এর পরের বছর ঘটে সবচেয়ে ভয়াবহতম শিল্প দুর্ঘটনাটি। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান ১ হাজার ২৩৯ জনের বেশি মানুষ। ভবনটিতে ছিল পাঁচটি পোশাক শিল্প-কারখানা। ভবনের অনুমোদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে নির্মাণ-পরবর্তী তদারকি প্রতিটি পর্যায়েই নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। সর্বশেষ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটে আরও একটি বড় শিল্প দুর্ঘটনা। এটি ঘটে একটি প্যাকেজিং কারখানায়। টাম্পাকো ফয়ল্স নামে ওই কারখানায় অগ্নিকা-ে ৪০ বছরের পুরানো ভবনটিই ধসে পড়ে। গত সোমবার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯ জনে। পোশাক কারখানা বাইরে দেশে টাম্পাকো ফয়ল্স’র মতো অনেক কলকারখানাই রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন শ্রমিকরা। এসব কারখানার অধিকাংশই অর্ধশত বছরের পুরানো। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রতিনিয়ত কাজ করেন শ্রমিকরা। নেই বিন্দুমাত্র অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপত্তায় নজরদারি ছিল না বলেই টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলসে কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য শুধু তৈরি পোশাক শিল্প নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজরদারি প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিস বা দমকল বাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে। তার প্রমাণ মেলে দুর্ঘটনাস্থলে পানিবাহী গাড়ি ও উদ্ধার কাজ আনুষঙ্গিক পরিচালনার সরঞ্জামের উপস্থিতি থেকে। কিন্তু রাসায়নিক কিংবা অন্য ধরনের দাহ্য পদার্থ রয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠানে, সেখানে আগুন দ্রুত আয়ত্তে আনায় যে সমস্যা রয়ে গেছে, সেটা টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের শিল্প খাতের প্রসার ঘটছে; কিন্তু ঝুঁকি সর্বনিম্ন মাত্রায় কমিয়ে রাখার সক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার আলী আহাম্মেদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, শিল্পায়নের শুরুতে নিরাপত্তার বিষয়ে মালিকদের উদাসীনতাই বর্তমান দুর্ঘটনাগুলোর মূল কারণ। তবে রানা প্লাজা ও তাজরীন ঘটনার পর দেশের শিল্পগুলোর মধ্যে পোশাক খাতের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। তারপরও অনেক খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সময় এসেছে দেশের সব শিল্প খাতে সমান মনোযোগী হওয়ার। তবে লোকবলসহ সরকারী সংস্থার সামর্থ্য ও ক্ষমতায়নের ঘাটতি আছে। নিরাপত্তা জোরদারে এগুলো নিশ্চিত করা জরুরী। গত তিন বছর ধরে নানা মনিটরিংয়ের পর এখনও অনেক কারখানার শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই। সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুরের বেশ কয়েকটি কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, পোশাকশিল্পে কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে দৃশ্যত কাজ হচ্ছে বলা হলেও পরিস্থিতি খুব বেশি পাল্টায়নি। মিরপুরের কালশীতে ২২ তলা বলে সুপরিচিত একটি কারখানা আছে। সেখানে শ্রমিকদের সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে হয়। ওঠার পর তারা বিন্দুমাত্র সময় পান না বিশ্রাম নেয়ার জন্য। ফলে শ্রমিকের ন্যূনতম মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। শ্রমিক নেতারা বলছেন, এ তো গেল ফরমাল সেক্টরের সমস্যা, ইনফরমাল সেক্টরের শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথাই তোলা হয় না। গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আকতার বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত সংশোধিত শ্রম আইন অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ্যাকর্ড এলায়েন্স যা করতে চেয়েছে সেটা শ্রমিকের জন্য নিরাপত্তা দেয়ার কথা। কিন্তু তাদের আওতায় সব কারখানা পড়েনি। ফলে শ্রমিকের কারখানা জীবনখুব উন্নত হয়েছে এটা বলার সময় আসেনি। এটা গেল গার্মেন্টের কথা। বেশিরভাগ শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কোন কথাই কখনও হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পোশাক শিল্পের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বলেন, পোশাক শিল্পের শ্রমিক কর্মীদের নিরাপত্তায় নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এদেশে কমপ্যাক্ট, এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এসব পদক্ষেপে কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি হচ্ছে। বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ২০১৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্সের মেয়াদ রয়েছে। তারা পোশাক খাতের অগ্রগতিতে কিছু শর্ত দিয়েছে। এর আগেই আমরা শর্ত পূরণে সমর্থ হব। বিজিএমইএর পূর্ণ সহযোগিতায় ৩ হাজার ৬৬০টি চালু কারখানা পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে বলে তিনি জানান।
×