ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানার রিগ্যান ৬ দিনের রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানার রিগ্যান ৬ দিনের রিমান্ডে

শংকর কুমার দে ॥ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার ঘটনার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। রিগ্যানের দেয়া জবানবন্দীতেই গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরীর নারায়ণগঞ্জের পাইকাপাড়ার জঙ্গী আস্তানায় আত্মগোপন করে থাকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি পান তদন্তকারীরা। এরপর পুলিশের ‘অপারেশন হিট স্ট্রং’ অভিযানে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ দুই জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। গুলশান হামলার অপর মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানসহ আত্মগোপনে থাকা অন্য জঙ্গীদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার জন্য রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে গুলশান হামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সূত্র জানায়, গত ২৫ জুলাই রাতভর রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ অভিযানে ৯ জঙ্গী নিহত হয়। পুলিশ অভিযানকালে পালিয়ে যাওয়ার সময় আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয় রাকিবুল হাসান রিগ্যান। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গী আস্তানার তথ্য দেয়। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়ই গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ অন্য জঙ্গীরা লুকিয়ে আছে বলে তথ্য দেয়। এরপরই নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানের সময় তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ আরও দুই জঙ্গী নিহত হয়। এরপর রাকিবুল হাসান রিগ্যান কিছুটা সুস্থ হলে তাকে হাজারীবাগ থানার একটি মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযানের মামলায়ও তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ মামলায়ও তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাকিবুল হাসান রিগ্যান জিজ্ঞাসাবাদে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তো পাওয়া গেছেই, সেই সঙ্গে তার কাছে গুলশান হামলার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। জঙ্গী রিগ্যান ৬ দিনের রিমান্ডে ॥ জঙ্গী রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রবিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। আবেদন শুনানি শেষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম গোলাম নবী। এর আগে রিগ্যানকে হাজারীবাগ থানার আরেকটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তিন দিনের হেফাজতে নেয়া হয়। কল্যাণপুরে অভিযানের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায়ও তাকে আসামি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গত ২৫ জুলাই রাতে জঙ্গী আস্তানার খোঁজে কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কে তাজ মঞ্জিল নামের ৬ তলা একটি ভবনের ৫ তলায় অভিযানে গিয়ে হামলার মুখে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। পরদিন ভোরে সেখানে সোয়াতের বিশেষ অভিযানে ৯ জঙ্গী নিহত হয়। কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের ‘অপারেশন স্টর্ম-২৬’ অভিযানকালে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হয় রাকিবুল হাসান রিগ্যান। তাকে পুলিশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। কল্যাণপুরে জাহাজ বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত জঙ্গী আস্তানায় অস্ত্র, বিস্ফোরকের পাশাপাশি আইএসের পতাকা ও কালো পাঞ্জাবি পাওয়ার কথা জানালেও পুলিশ দাবি করেÑ হতাহতরা সবাই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গী দল নব্য জেএমবির সদস্য। প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই রাতে ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় নজিরবিহীন সন্ত্রাসী হামলায় ১৭ বিদেশীসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গীরা। হামলার পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানের পর সেখান থেকে পাঁচ জঙ্গীসহ ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আর জঙ্গীদের ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। গুলশানের হামলায় ৫ জঙ্গী নিহত হলেও তাদের সহযোগী জঙ্গীদের অনেকেই পলাতক আছে। পলাতক জঙ্গী ও জঙ্গী তৎপরতা সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়ার জন্যই গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে। কল্যাণপুর জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের দুই মাস ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযান দুই মাস আগে অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৫ জুলাই রাতভর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানার খোঁজে অভিযান চালানো হলে পরদিন ২৬ জুলাই ভোরে ৯ জঙ্গীর লাশ পাওয়া যায় জঙ্গী আস্তানায়। কল্যাণপুরে জাহাজ বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহত ৯ জঙ্গীর মধ্যে ৮ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলেও এখনও পর্যন্ত এক জঙ্গীর পরিচয় শনাক্ত হয়নি। পরিচয় নিশ্চিত হওয়া অপর ৮ জন হলোÑ আবদুল্লাহ, আবু হাকিম নাঈম, তাজ-উল-হক রাশিক, আকিফুজ্জামান, সাজাদ রউফ অর্ক, জুবায়ের হোসেন, মতিয়ার রহমান ও তারেক। এই ৯ জনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের মরচুয়ারিতে সংরক্ষণ করা আছে। এরই মধ্যে শনাক্ত হওয়া ৮ জনের স্বজনদের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করে নাম-পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত সংস্থা। কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত তাজ মঞ্জিলে পুলিশের জঙ্গীবিরোধী অভিযান শেষে বাড়ির মালিক মমতাজ বেগমের ছেলে এ্যাডভোকেট মাজহারুল ইসলাম জুয়েল, কেয়ারটেকার মাহফুজুল আনসারী, দুইজন মেস বোর্ডার রাকিব ও মোমিনসহ ৪২ জনকে আটক করা হয়। পরে ওই ৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। গ্রেফতারকৃতদের দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জাহাজ বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত এই ছয়তলা ভবনটি এখন পরিত্যক্ত। ভাড়াটিয়া বাসিন্দারা বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়ির পাঁচতলার ফ্ল্যাটে পুলিশ জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালায়। ফ্ল্যাটটি এখনও মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে সংরক্ষণ করা আছে। বাড়ির সামনে এখনও পুলিশ প্রহরা রয়েছে। এখনও ৮ জঙ্গী ধরাছোঁয়ার বাইরে ॥ রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অপারেশন স্টর্ম-২৬ অভিযানের ঘটনায় মিরপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) শাহ্্জালাল আলম বাদী হয়ে ১০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং’ অভিযানে তামিম আহমেদ চৌধুরী নিহত হয় এবং রাকিবুল হাসান রিগ্যান গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হয়। অপর ৮ জনকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। কল্যাণপুর জঙ্গী অভিযানের মামলার আসামি যে ৮ জন গ্রেফতার হয়নি তারা হলোÑ ইকবাল, রিপন, খালিদ, মামুন, মানিক, জুনায়েদ খান, বাদল ও আজাদুল ওরফে কবিরাজ। কল্যাণপুরের জঙ্গী আস্তানায় গ্রেফতার হওয়া রাকিবুল হাসানকে কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ নারায়ণগঞ্জে জঙ্গীবিরোধী অভিযান চালানোর সময় তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন নিহত হয়। দুই জঙ্গী কি ভারতে ॥ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, সন্দেহভাজন জঙ্গীদের মধ্যে রিপন ও খালিদ গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা খুব সম্ভব ভারতে আত্মগোপন করেছে। একের পর এক জঙ্গী হামলার মূলহোতা, অস্ত্রদাতা, অর্থদাতা, প্রশিক্ষণ ও জঙ্গীদের আশ্রয়দাতাদেরও চিহ্নিত করা গেছে। পুলিশের ওই সাহসী অভিযানে আরও বড় জঙ্গী হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ওই ঘটনার পর গত দুই মাসে দেশে জঙ্গীদের শিকড় সন্ধানে বড় সফলতা এসেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
×