মোরসালিন মিজান ॥ অপরূপ সৌন্দর্যের বাংলাদেশ। আর এ সৌন্দর্যের প্রধানতম অনুষঙ্গ নদী। এখানে নদীকেন্দ্রিক জীবন। সভ্যতা। সংস্কৃতি। আলোকচিত্রীরা সৌন্দর্যের কিছু ক্যামেরাবন্দী করেছেন। তবে সঙ্গতকারণেই বেশি এসেছে কান্নাটা। নদীর দেশেই আজ নদী ভাল নেই। নদীর দেশে মরে যাচ্ছে নদী। আশ্চর্য অবহেলা-দূষণ-দখল। চলছেই। এ অবস্থায় জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত প্রদর্শনী একই সঙ্গে প্রতিবাদ। নদী বাঁচানোর আবেদন। প্রধান মিলনায়তনের লবিতে রবিবার এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়।
এখন প্রধান মিলনায়তনের লবিজুড়ে নদীর ছবি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে এসব ছবি তুলেছেনÑ মাহমুদ অপু, আবু তাহের খোকন, খুরশেদ আলম রিংকু, রিয়াজ আহমেদ সুমন, রহিত অলি রাজীব, শরীফ সারোয়ার, সানি রামানি, জীবন আহমেদ, নাহিদ মুরাদ, রাশেদ সুমন, এনামুল হক, জাহিদুল ইসলাম সজল, মাহবুব হোসেন নীবন, শাহাদাত পারভেজ, মোহাম্মদ আসাদ, সাইফুল ইসলাম রনি প্রমুখ।
প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া নদীর কোনটি নিহত প্রায়। আহত কোনটি। নদীর বুকে অগণিত খুঁটি পুঁতে রেখেছে অবৈধ দখলদার। নগর বড় হতে হতে নদীকে ঘ্রাস করেছে। আলোকচিত্রী জীবন ঘোষের একটি ছবিতে বুড়িগঙ্গা দখলের চিত্র। নদীর তীর দখল করে ছোট ছোট ঘর তোলা হয়েছে। নিচে যে জল, জলের চেহারায় নেই। প্রাণহীন। জমাট। স্বাভাবিক প্রবাহ ভুলে গেছে। দূষণের শিকার নদীর জল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কালো। যে সে কালো নয়, চোখ যেন অন্ধ হয়ে আসে! ভাসমান আবর্জনাও নদীকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। ইন্দ্রজিত ঘোষের ছবিটি হতে পারে উদাহরণ। এখানে নোংরা পানির উপর ভাসমান আবর্জনার স্তূপ। তরমুজের খোসা এত ঘন হয়ে আছে যে, জল দেখা যায় না। পাশের ছবিতে পলিথিন। পলিথিনের স্তূপ। রঙিন জলের ধারা দেখে আরও বেশি অবাক হতে হয়। লাল নীল বেগুনিÑ কত রঙের ছড়াছড়ি! আদতে কারখানার বর্জ্য গায়ে মেখে এমন রঙিন হয়ে ওঠেছে পানি। একটি আলোকচিত্রে জল দেখে আঁতকে ওঠতে হয়, রক্তের মতো লাল! কারখানায় ব্যবহার করা কেমিক্যাল পানির স্বাভাবিক রং কেড়ে নিয়েছে। সৈয়দ জাজির হোসেনের তোলা একটি ছবিতে একাধিক রং। লাল হলুদ সাদা রঙের মিশেলে নদীর যে জল, মনে হয় বরেণ্য শিল্পীর চিত্রকর্ম! অনেকে আবার পানি ব্যবহার করার নামে ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে দিচ্ছেন নদীর পানিতে। সবই তুলে এনেছেন আলোকচিত্রীরা। বলার চেষ্টা করেছেন, কী করে আহত হচ্ছে নদী।
মরা নদীর সংখ্যাও কম নয়। এক সময় অথৈ জল ছিল। ঢেউ ছিল। এখন বিরান ভূমি। একটি ছবিতে টপ ভিউ। সেখানে জলের রেখাগুলো এখনও পড়া যায়। কিন্তু জল নেই। চৌচিড় ভূমির মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার পথ হয়েছে!
অবশ্য আহত-নিহত নদী থেকে চোখ সরাতেই মন ভরে যায়। বাংলার চিরচেনা নদীর রূপ মুগ্ধ করে রাখে। তেমন একটি ছবিতে জাদুকাটা নদী। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর থেকে তোলা। সচল নদীর বুকে অসংখ্য নৌকা নোঙর করে আছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। একই রকম আরেকটি ছবিতে বাঁশবোঝাই নৌকার সারি। বারবার দেখা। তবু ভাল লাগে।
আলোকচিত্রীরা চমৎকার ছবি তুললেও উপস্থাপনা দুর্বল এবং ত্রুটিপূর্ণ। এসব ত্রুটির কথা বাদ দিলে দখল-দূষণে ক্লিষ্ট নদী সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে প্রদর্শনী থেকে। চার দিনব্যাপী প্রদর্শনী চলবে বুধবার পর্যন্ত।